Friday 11 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আ.লীগ আমলের পাবলিক পরীক্ষা
প্রাপ্য নম্বরের চেয়ে বেশি দিয়ে বাড়ানো হতো পাসের হার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ জুলাই ২০২৫ ২০:২৩ | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫ ২০:৩০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘অলিখিত নির্দেশনায়’ পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের পাওয়া নম্বরের সঙ্গে অতিরিক্ত নম্বর যোগ করে পাসের হার ও গ্রেড পয়েন্ট বাড়ানো হতো। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের দেওয়া বক্তব্যে এমন ‘তথ্য’ মিলেছে। তবে এবার মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে ‘ওভারমার্কিং কিংবা আন্ডারমার্কিংয়ের’ কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন। এরপর ফলাফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী।

বিজ্ঞাপন

গত ১০ এপ্রিল সারাদেশে শুরু হয়েছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীন চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর, তিন পার্বত্য জেলা এবং কক্সবাজার মিলিয়ে এবার পরীক্ষার্থী ছিল মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৩ জন। উপস্থিত ছিলেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৮৮ জন।

প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, চলতি বছরে পাস করেছেন ১ লাখ ১ হাজার ১৮১ জন। ফেল করেছেন ৩৯ হাজার ২০৭ জন। পাসের হার ৭২ দশমিক ০৭ শতাংশ।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে গত দশ বছরের চেয়ে এবার এসএসসিতে পাসের হার সর্বনিম্ন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭৮ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৮৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ছিল ৮২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

পাসের হারে এমন ধসের বিষয়ে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে আছে- পাহাড়ের জেলাগুলোর পরীক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকা, পাসের হার বাড়ানোর চেয়ে শিক্ষার মান নিয়ে কঠোর থাকা এবং গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় পাঠদান ব্যাহত হওয়া।

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নে এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল- কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটি।

চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে আরও যোগ করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের আগের পরীক্ষাগুলোতে অলিখিত কিছু কথাবার্তা থাকতো, যেমন- কেউ ৩৮ নম্বর পেলে তাকে ন্যূনতম একটা গ্রেড পয়েন্টে কনভার্ট করার চেষ্টা করা হতো। এটা কেউ করেছেন, কেউ করেননি। আগে কেউ ৪৮ কিংবা ৪৯ নম্বর পেলে তাকে যদি ৫০ করে দেওয়া হতো, তাহলে সে গ্রেড বেনিফিটটা পেত।’

‘কিন্তু এবারের নির্দেশনায় একেবারে শুরু থেকে এ জাতীয় কোনো কথাবার্তা ছিল না। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কিংবা বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাবোর্ড এবার এ জাতীয় কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’

এ বিষয়ে আরও স্পষ্টভাবে জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের বছরগুলোতে অনেকসময় ওভারমার্কিং হতো। এটা আমরা শুনেছি, আপনারাও যেমন শুনেছেন। কিন্তু এবার আমাদের উপদেষ্টা (শিক্ষা) মহোদয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল যে, ওভারমার্কিং-আন্ডারমার্কিং কিছুই করা যাবে না। পরীক্ষার্থীরা খাতায় যা লিখেছেন, সেটার ওপর ভিত্তি করেই মূল্যায়ন করতে হবে। এবার আমরা এটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে ওভারমার্কিং-আন্ডারমার্কিং হয়নি।’

আরেকটি কারণ ‘ধারণাগত’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। অনেকদিন তারা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত ছিল। এটাও কিন্তু একটা কারণ যে, তারা ঠিকমতো তাদের পাঠদান কার্যক্রমটা কমপ্লিট করতে পারেনি।’

পাহাড়ের অনগ্রসরতা সার্বিক ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে উল্লেখ করে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীন পাঁচটি জেলার যে ভৌগলিক অবস্থান, এখানে তিনটি পার্বত্য জেলা আছে। এই তিনটি পার্বত্য জেলার ভৌত অবকাঠামো, পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত, সর্বোপরি একটা অনগ্রসর অবস্থানের মধ্যেই কিন্তু সেগুলো আছে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকেই ফলাফলটা চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঠিক থাকে, জেলায়ও ঠিক থাকে, কক্সবাজারেও ঠিক থাকে, কিন্তু আমরা যখনই পাহাড়ের দিকে যাই, তখন আস্তে আস্তে ডাউন হতে থাকে। এটার কারণ হচ্ছে- পাহাড়ের সুযোগ-সুবিধা, পাহাড়ের অবকাঠামো চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার তুলনায় অনেক পিছিয়ে।’

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘আমাদের জিওগ্রাফিক্যাল পজিশন তো আমরা চেঞ্জ করতে পারবো না। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের বয়স যদি ২৮ থেকে ২৯ বছর হয়, প্রত্যেক বছরই কিন্তু পাহাড়ের রেজাল্টটা আমাদের ভোগায়। ওখানে ফ্যাসিলিটি যদি বাড়ে, পরীক্ষার রেজাল্টও ইমপ্রুভ হবে। এজন্য সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা লাগবে। চট্টগ্রাম শহরে একটা স্কুলে যে ফ্যাসিলিটি আছে, সেটা দীঘিনালার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেই। এমনকি শহরতলীর স্কুল, ধরেন পটিয়ার রাহাত আলী স্কুলে যে ফ্যাসিলিটিটা আছে, সেটা তো লংগদুর ওই স্কুলে নেই।’

‘সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। অন্যান্য সাবজেক্টের শিক্ষক গিয়ে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। আমি এমনও ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, অ্যাকাউন্টিংয়ের টিচার গিয়ে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি পড়াচ্ছেন। মন্ত্রণালয়েও আমাদের সবসময় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেখানেও আমরা একই কথা বলি। পাহাড়ের অনগ্রসরতা যদি কমাতে হয়, তাহলে এখানে যেসব ফ্যাসিলিটিজ আছে, সেই অনুপাতে পাহাড়ে ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে হবে। অবকাঠামোর ঘাটতি রিকভার করতে হবে।’

চলমান এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে তিন পার্বত্য জেলায় স্কুলে-স্কুলে গিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান।

প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, পাহাড়ের তিন জেলাতেই এবার পাসের হার গতবছরের চেয়ে কমেছে। এর মধ্যে রাঙামাটিতে পাসের হার ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৬০ দশমিক ৭৭ ও বান্দরবানে ৬৩ দশমিক ১২ শতাংশ। গতবছর রাঙামাটিতে ৭২ দশমিক ৭২ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৭২ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং বান্দরবান জেলায় ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ পাসের হার ছিল।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এবার পাসের হার ৮১ দশমিক ০৩ শতাংশ। আর নগরী বাদে জেলায় পাসের হার ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গতবছর নগরীতে ৮৭ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং নগরী বাদে জেলায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ ছিল। কক্সবাজার জেলায় এবার পাসের হার ৭০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গতবছর ৮৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ ছিল।

এ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ফেল করা ৩৯ হাজার ২০৭ জনের অধিকাংশই পাহাড়ের তিন জেলা থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

এবার বিজ্ঞানে পাসের হার ৯২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, গতবার ছিল ৯৪ দশমিক ৫২। মানবিকে পাসের হার ৫৫ দশমিক ০২ শতাংশ, গতবার ছিল ৭৩ দশমিক ৪১। ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৭৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, গতবার ছিল ৮৪ দশমিক ১১।

মানবিকে পাসের হার কমে যাওয়ার প্রভাবও সার্বিক ফলাফলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ। তবে একজন পরীক্ষার্থীরও ফলাফল এবার স্থগিত রাখা হয়নি, যা অন্যান্য বছরের চেয়ে ব্যতিক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবার কারও ফলাফল কিন্তু স্থগিত নেই। অর্থাৎ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে, তার একটা রেজাল্ট পেয়েছে, পাস অথবা ফেল কিন্তু ঝুলন্ত অবস্থায় কেউ নেই। এ জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। যারাই পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের সবাইকে আমরা একটা ফলাফল দিতে পেরেছি।’

এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১১ হাজার ৮৪৩ জন পরীক্ষার্থী, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৩ জন ছাত্রী এবং ৫ হাজার ৪৯০ জন ছাত্র। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ১০ হাজার ৪৫৮ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ১ হাজার ২৪৭ জন এবং মানবিকে পেয়েছেন ১৩৮ জন পরীক্ষার্থী।

তবে এবার ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা বিদ্যালয়ের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘আমাদের উপদেষ্টা (শিক্ষা) মহোদয় প্রত্যেক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান স্যারদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে টপ-টেন স্কুলের তালিকা করা না হয়। কারণ, টপ-টেন বা টপ-টুয়েন্টি তালিকা হলে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।’

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ২১৯টি কেন্দ্রে ১ হাজার ১৬৪ টি বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা এবার এসএসসিতে অংশ নিয়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, শতভাগ পাস করেছে এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে ৩৩টি হয়েছে, গতবছর ছিল ৪৬টি। শুধুমাত্র একটি বিদ্যালয়ে পাসের হার শূন্য পাওয়া গেছে। সেটি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট উচ্চ বিদ্যালয়। ওই বিদ্যালয় থেকে দুজন পরীক্ষা দিয়ে দুজনই ফেল করেছেন বলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানিয়েছেন।

এবার এবার মোট ৭৮ হাজার ৭২৫ জন ছাত্রী ও ৬১ হাজার ৬৬৩ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাসের হার প্রায় সমান। ছাত্র পাসের হার ৭১ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং ছাত্রী পাসের হার ৭২ দশমিক ১৯ শতাংশ। এবার ২৪ হাজার ৬৬৮ জন পরীক্ষার্থী এক বিষয়ে ফেল করেছে। হার ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

সারাবাংলা/আরডি/এসআর

আ.লীগ আমল পাবলিক পরীক্ষা পাসের হার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর