ঢাকা: ১১ জুলাই ২০২। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘বাংলা ব্লকেড’ শিক্ষার্থীদের জাগরণের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছিল। নিয়োগের ক্ষেত্রে সব গ্রেডে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক কোটা বাতিলের দাবিতে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের ১১তম দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। শাহবাগ থেকে শুরু করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে গর্জে ওঠে ছাত্রদের একক স্লোগান— ‘কোটা নয়, চাই মেধার মূল্যায়ন।’
কোটা নিয়ে উচ্চ আদালতের অবস্থান
১১ জুলাই হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিলসংক্রান্ত সরকারি পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। তবে রায়ে বলা হয়, সরকার চাইলে কোটার হার বা সংখ্যা পরিবর্তন করতে পারবে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি থেকে যায় সরকারের কাঁধেই।
থেমে থাকেনি ছাত্রদের কর্মসূচি
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে যান শিক্ষার্থীরা। যদিও তার আগে থেকেই পুলিশ সেখানে অবস্থান নেয়।
ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ
পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, এদিন বিকেল ৩টার পর আন্দোলনকারীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। শিক্ষার্থীরা বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
এদিন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত থাকতে হবে। ব্লকেড কর্মসূচির নামে রাস্তায় নামলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানায় পুলিশ। আন্দোলনকারীরা যাতে শাহবাগ থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দিকে যেতে না পারেন, সেজন্য রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। সেখানে জলকামান ও সাঁজোয়া যান প্রস্তুত রাখা হয়।
শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মিছিল শুরু করলে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়, শাহবাগে ব্যারিকেড অতিক্রম করলে পুলিশ ‘অ্যাকশনে’ যাবে। পরে বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে সেই ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মেট্রো স্টেশনের নিচে অবস্থান নেন। তখন পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়।
শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীরা ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘ভয় দেখিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘হামলা করে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
এদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন রাজধানীর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে বিকেল ৪টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এতে ১০ শিক্ষার্থী আহত হন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ফটকে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল ৪টার দিকে মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেন এবং সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
দেশব্যাপী আন্দোলনেও পুলিশের বাধা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ভবনের সামনে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের মধ্যে নয়জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিন আন্দোলনরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে সাতজন আহত হন। পরে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেটে এসে সড়ক অবরোধ করেন।
সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল ৪টার দিকে ক্যাম্পাসের গোলচত্বর থেকে মিছিল বের করে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে পাঁচজন আহত হন।
এ ছাড়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী রেলপথ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুলনার জিরো পয়েন্ট, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যশোর-রাজশাহী মহাসড়ক এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়াও, পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য
এদিন সকাল থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, পুলিশ, ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে বলা হয়, কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের আদেশের পর শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলন বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা বাংলা ব্লকেডের নামে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘অনেকেই তাদের (আন্দোলনকারীদের) ব্যবহার করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রে পা না দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিন। তারা মেধাবী ছেলে, কেন তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাবে? জানমালের ক্ষতি করলে, অগ্নিসংযোগ করলে, জনদুর্ভোগ করলে তো পুলিশ বসে থাকবে না।’
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যেতে উপাচার্যদের কাছে ইউজিসির চিঠি
এদিন সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে উপাচার্যদের চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এ চিঠি পাঠানো হয়।
ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের দাবি করা হয়, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা চলছে।
নতুন কর্মসূচি
পুলিশি হামলার প্রতিবাদে পরদিন ১২ জুলাই (শুক্রবার) সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।