ঢাকা: ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) প্রকাশিত হয়েছে। এবার ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফল করে তাদের পরিবারকে গর্বিত করেছে, আবার অনেকে আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশ হয়েছে। এবারের ফলাফলে পাসের হার গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, যা শিক্ষা বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আলেয়া খানম রিতা, যার মেয়ে নওরীন ইসলাম নাবিহা এবার এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তিনি সারাবাংলাকে জানিয়েছেন তার উচ্ছ্বাসের কথা। তিনি জানান, গত কয়েক বছরের সাধনার ফল তিনি আজ পেয়েছেন। মেয়ের সাফল্যের জন্য নিজের সব শখ বিসর্জন দিয়ে কেবল একটি লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগিয়ে গেছেন। মেয়ের এই সাফল্যে তিনি মনে করছেন যেন তিনি নিজেই কোনো বড় যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন।
অন্যদিকে, তাহিয়া তামান্না (ছদ্মনাম) নামে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তার সন্তানের ফলাফল নিয়ে হতাশ। তাহিয়া সব বিষয়ে ভালো ফল করলেও গণিতে ফেল করেছে। তার অভিভাবক সারাবাংলাকে জানান, তার চার সন্তানের মধ্যে তাহিয়াকে নিয়ে তার অনেক আশা ছিল, কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। তিনি এই ফলাফল মেনে নিতে পারছেন না। অভিভাবকদের এই হাসি-কান্না মিশ্রিত চিত্র সারাদেশেই দেখা যাচ্ছে।
এদিকে, মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, এবার তার স্কুলের পাশের হার ৭৭ শতাংশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার এই ফলাফলে তিনি ফলাফল নিয়ে কোনো মতামত দিতে চান না।
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের (৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ) তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমেছে। এটি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার। শুধু তাই নয়, পূর্ণাঙ্গ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭ জন।
এ বছর দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে গড় পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
জানা গেছে, ২০১০ সালের পর ২০২১ সালে রেকর্ড ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করে। এই সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল সবচেয়ে কম, ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে সেটাও ছিল এবারের চেয়ে কম।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, ফলাফল নিম্নমুখীর অন্যতম কারণ হলো ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অবসান’। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘গোপন নম্বর বাড়ানো নীতির’ বদলে এবার খাতাভিত্তিক প্রকৃত মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রস্তুতি ও সক্ষমতার প্রতিফলন ঘটেছে ফলাফলে।
আর এর অন্যতম একটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পাবলিক পরীক্ষার খাতার নাম্বার বাড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ, পরীক্ষার খাতায় কেউ ৭৮ নম্বর পেলে গ্রেড পরিবর্তনের জন্য ২ নম্বর বাড়িয়ে ৮০ করা কিংবা ৩০ নম্বর পেলে ৩৩ করে পাস করিয়ে দেওয়া অলিখিত নির্দেশনা বা উপরের মহলের চাপ ছিল। তবে এবার সেরকম কোনো নির্দেশনা বা চাপ আসেনি। ফলে শিক্ষার্থীরা যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছেন, প্রকৃত মূল্যায়নে সেই ফলাফল তাদের হাতে পৌঁছানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আজকের এই রেজাল্টের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন-জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের অবস্থা স্থিতিশীল না। এই আন্দোলনে এসএসসি পরীক্ষার্থী অনেকেই অংশ নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তারা তো স্বাভাবিক ছিলেন না। তারা শকড ছিলেন। ফলে স্বাভাবিভাবে পরীক্ষায় খারাপ ফল হবে।’’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষা নির্ভর, পারিবারিক চাপে শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ পেতেই হবে এমন একটি ধারণা চালু আছে। ফলে এসব চাপ শিক্ষার্থীরা নিতে পারে না। তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ থেকে উত্তরণে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে।’
সেসঙ্গে তিনি এবারের এসএসসি ফলাফলকে গবেষণা করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কমিটি এবারের রেজাল্টের কেন এমন অবস্থা, ইম্পেক্টটাকে কি সেটা এনালিসিস করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করবে।
এতে করে সঠিক কারণগুলো বের হয়ে আসবে এবং সেই বিষয়ে সঠিক পদক্ষপ নিয়ে কাজ এগিয়ে নিলে ভবিষ্যতে ভালো ফ্লাটফল হবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।