Saturday 12 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুম কমিশনের প্রতিবেদন
নির্যাতনে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরতো

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১২ জুলাই ২০২৫ ২২:০৮ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫ ২২:০৯

গুমের পর নির্যাতন। প্রতীকী ছবি

ঢাকা: টগবগে তরুণ আদনান (ছদ্মনাম)। সবে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হাল ধরতে হবে পরিবারের। এসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই তাকে তুলে নিয়ে যায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বিনা অপরাধেই টানা ৩৯ দিন আটকে রাখে গোপন বন্দিশালায়। এ সময় চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। এই তরুণকে অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা ভিন্নরকমের। গামছা দিয়ে তার মুখ ঢেকে পানি ঢালতেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। এতে শ্বাসরোধের যন্ত্রণায় হাউমাউ করে কাঁদতেন। তবু মন গলতো না তাদের। এমনকি অজ্ঞান হওয়ার পরও চালিয়ে যেতেন ভয়াবহ নির্যাতন।

লোমহর্ষক এমনই বর্ণনা উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। জুনের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি জমা দেয় এই কমিশন। তবে সম্প্রতি ওই প্রতিবেদনের একটি অংশ প্রকাশ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষায়িত ইউনিটের মাধ্যমে এসব নির্যাতন চালানো হতো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে র‌্যাবের হাতে গুম হন ওই তরুণ। কমিশনের কাছে দেওয়া নিজের জবানবন্দিতে গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের সেসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি। এই তরুণ বলেন, ‘অনার্স শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউও দিয়েছি। কিন্তু ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে হঠাৎ একদিন আমাকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যান কয়েকজন। পরে জানতে পারি র‌্যাবের হাতে আমি বন্দি। আমাকে সংকীর্ণ এক গোপন কক্ষে আটকে রাখেন তারা।’

তিনি বলেন, “নির্যাতনের সময় প্রথমে গামছা দিয়ে আমার মুখ ঢেকে ফেলতেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। এর পর পানি ঢালতেন। জগভর্তি পানি ঢাললে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। এক পর্যায়ে গামছা সরিয়ে তারা বলেন- ‘বল কী করছিস’। জবাবে আমি বলি- ‘স্যার, আপনি আমাকে কেন ধরে এনেছেন’। তখন বলা হয়- ‘না, ওরে হবে না। এটা বলে আবারও গামছা দিয়ে পানি ঢালতেন।”

নির্যাতনের এ পদ্ধতির নাম ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ বা জলপীড়ন। কাউকে আবার ‘বাঁশ ডলা’ দেওয়া হতো। প্রতিবেদনে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়া ২৭ বছর বয়সী এক যুবকের তথ্য তুলে ধরা হয়। তাকেও ২০১৭ সালে অপহরণ করে র‌্যাব-১০ এর সদস্যরা। তিনি ১৯ দিন গুম ছিলেন।

কমিশনকে এই ভুক্তভোগী বলেন, “বন্দিশালায় শোয়ানোর পর আমার দুই হাতের ওপর দিয়ে আর ঘাড়ের নিচে একটি বাঁশ দেন র‌্যাব কর্তারা। পায়ের ও রানের নিচ দিয়ে আরেকটি দেন। রানের ওপরে দিয়েও একটি দেওয়া হয়। এভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখেন তারা। তখনও বড় স্যার আসেননি। কিছুক্ষণ পর তিনি এলেন। এসেই আমাকে বলেন ‘এই ওঠো’। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় আমি আর দুনিয়ায় নেই। মানে যন্ত্রণা শুরু হয়। মনে হয়েছে কেউ আমার হাত-পায়ের মাংস ছিঁড়ে ফেলছে।”

২০১৯ সালে র‌্যাব-১১ এর হাতে গুম হন আরেক ‍যুবক। ২৭ বছর বয়সী এই যুবক বন্দি ছিলেন প্রায় দেড় মাস। কমিশনকে দেওয়া তার ভাষ্যমতে, ‘তাকে প্রথমে বাঁধা হতো। পরে এক হাঁটুর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেন। এক পর্যায়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে লাঠি ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখতেন। এতে তার দুই পা ওপরে আর মাথা নিচে থাকতো। শরীরে কোনো পোশাক রাখা হতো না। এর মধ্যেই দু’জন মিলে একসঙ্গে এলোপাতাড়ি পেটাতেন। নির্যাতনের কারণে ওই সময় চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। এছাড়া নাকে-মুখে চড়-থাপ্পড়ও দিতেন তারা।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে ২৮ বছর বয়সী আরেক যুবকের ভয়াবহ নির্মমতার চিত্র তুলে ধরা হয়। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাব-২ এর হাতে গুম হয়ে এই যুবক ২০৮ দিন গোপন বন্দিশালায় ছিলেন। জবানবন্দিতে এই ভুক্তভোগী বলেন, ‘প্রথমে আমার মাথা ও হাত-পা বাঁধা হয়। এরপর একটি মেশিনে ওঠান বাহিনীর সদস্যরা। মেশিন চালানোর পর মনে হয়েছে আমার হাড় যেন পুরো আলাদা হয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মেশিনটি অনেকটা আজব মনে হলো। তারা আমাকে বলতেন- ‘তুমি পিঠ একেবারে লাগিয়ে রাখো। এখানে উঠলে সবাই পায়খানা করে দেয়। এ ছাড়া, মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনও কখনও উল্টানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। মেশিনের ওপর শোয়ানো রাখা অবস্থাতেই আমার হাঁটুর ওপর মারতেন তারা। আর জিজ্ঞাসাবাদ করতেন।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্দিশালায় নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরে যেন না যায়, সেজন্য একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুমের শিকার হন নিরীহ মানুষ। তাদের আটকের কোনো রেকর্ডও রাখতেন গোয়েন্দা সংস্থা বা বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।

এছাড়া জনসম্মুখে হাজির করার আগে ভুক্তভোগীদের নির্যাতনের চিহ্ন লুকানোর চেষ্টা করতেন তারা। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ক্ষতস্থানে ওষুধ বা মলম লাগানো হতো। আবার ক্ষতচিহ্ন মোছা না পর্যন্ত অনেকের মুক্তিও মিলতো না। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কেউ কেউ এসব ক্ষত নিয়েই হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু সেসবে ভ্রূক্ষেপ করতেন না দায়িত্বরতরা। আইন উপক্ষো করে এভাবেই বহু মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন নির্দিষ্ট কিছু বাহিনী।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

আয়নাঘর গুম কমিশন গোপন বন্দিশালা চামড়া প্রতিবেদন ফেটে যুবক রক্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর