ঢাকা: জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের একবছর পার হতে চলেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ওই বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই ন্যূনতম সংস্কার শেষে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করে আসছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম দল বিএনপিসহ অন্যান্যরা। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন যে, আগামী বছরের এপ্রিলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচনের তারিখ ফেব্রুয়ারিতে আনার প্রস্তাব করা হয়। ড. ইউনূস বিএনপির সেই প্রস্তাবে সরাসরি রাজি না হলেও বলেছেন যে, ‘নির্বাচন হতে পারে’। কাছাকাছি সেই দুই সময়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গত ৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশও দিয়েছেন। এমন অবস্থায় গত ১০ জুলাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বড় চ্যালেঞ্জ
তবে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি তাতে ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, গত ৯ জুলাই ব্যবসায়ী সোহাগকে কংক্রিটের টুকরো দিয়ে পিটিয়ে হত্যা এবং মৃত্যুর পর লাশের ওপর লাফানোর ঘটনায় দেশজুড়ে সবার মাঝে এই শঙ্কা আরও বেশি জোরালো হয়েছে। কারণ, এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নাজুক। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই পরবর্তী বর্তমান এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না।
এমন পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত সব কাজ শেষ করে জাতিকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়াকে বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জিংয়ের কারণ হলো, আইনশৃঙ্খলার অবনতি। ভোটাররা যদি সুষ্ঠু পরিবেশে নিশ্চিন্তে ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে, তাহলে সব কমিশনের কাজ ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সব আত্মদানই বৃথা যাবে। যা আমরা কেউ-ই চাই না।’
তাই বর্তমানের এই অবস্থা থেকে উত্তরণে নির্বাচন কমিশনকে একটি ‘সমন্বিত নির্বাচন নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ গ্রহণের পরামর্শ এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞের। ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘সমন্বিত নির্বাচন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যারা থাকবেন, তারা প্রথমে নিরাপত্তার ইস্যুগুলো খুঁজে বের করবেন। তারা খুঁজে দেখবেন, ঝুঁকিগুলো কোথায়। এর পর সেই ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় নিয়ে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। তবে যে কমিটিই কাজ করুক তাদের অবশ্যই সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে সমন্বয়টা বেশি জরুরি।’ সেইসঙ্গে নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ যে কেন্দ্রগুলো আছে সেগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পরামর্শও দেন এই নির্বাচন এই বিশেষজ্ঞ।
নির্বাচন প্রস্তুতিতে পাঁচ কমিটি
গত ৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করার নির্দেশনার পরদিনই নির্বাচনি প্রস্তুতিতে পাঁচটি কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন। কমিটিগুলো হলো- ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তদারকি সংক্রান্ত কমিটি, আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটি, মাঠ প্রশাসনের সাথে সমন্বয় কমিটি, নির্বাচনি আইন, বিধি, প্রবিধি, নীতিমালা এবং ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি (নির্বাচনি তদন্ত) কমিটির কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয় কমিটি এবং দেশের বাইরে ভোটদান এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সম্পর্কিত কার্যাবলি সমন্বয় কমিটি।
নির্বাচন সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এই পাঁচ কমিটিতে প্রধান হিসেবে আছেন চারজন নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনি তদন্ত কমিটির কার্যক্রম তদারকি কমিটির সভাপতি করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদকে। কমিটির সাত সদস্য হলেন- ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, মুখ্যসচিব (আইন), যুগ্মসচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-১), উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২) এবং উপসচিব (নির্বাচন সহায়তা ও সরবরাহ)। এ ছাড়া, কমিটি প্রয়োজনে যে কোন কর্মকর্তাকে কো-অপ্ট করতে পারবে।
এই কমিটি নির্বাচনি আইন, বিধি, প্রবিধি, নীতিমালা এবং ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি (নির্বাচনি তদন্ত) কমিটির কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয় করবে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহকে সভাপতি করে আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, প্রকল্প পরিচালক, আইডিইএ প্রকল্প (২য় পর্যায়), যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ), যুগ্মসচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২) এবং উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২)। এ ছাড়া, কমিটি প্রয়োজনে যেকোনো কর্মকর্তাকে কো-অপ্ট করতে পারবে।
কমিটির কার্যপরিধি হবে- নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের তদারকি ও সমন্বয়। ব্যালট পেপারসহ বিভিন্ন নির্বাচনি মালামাল পরিবহণ, বিতরণ এবং ভোটগ্রহণ কাজে নিরাপত্তা বিধানের জন্য মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করে রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসারদের সহায়তা প্রদান।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকে সভাপতি করে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ), যুগ্মসচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২), উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২)। এ ছাড়া, কমিটি প্রয়োজনে যেকোনো কর্মকর্তাকে কো-অপ্ট করতে পারবে।
কমিটির কার্যপরিধি হচ্ছে- নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনে নিয়োজিত/দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়মিত যোগাযোগ। সমন্বয় ও পরামর্শ প্রদান, মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনি কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান, মাঠ প্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশনে তথ্য পাঠানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী রিপোর্টিং পদ্ধতি প্রবর্তন ও মনিটরিং। আচরণবিধি প্রতিপালনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে সমন্বয় ও পরামর্শ প্রদান।
নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদকে সভাপতি করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তদারকি সংক্রান্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ), যুগ্মসচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২,) উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২)। এ ছাড়া, কমিটি প্রয়োজনে যেকোনো কর্মকর্তাকে কো-অপ্ট করতে পারবে।
এই কমিটির কার্যপরিধি হচ্ছে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি কর্মকর্তা/ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, তদারকি এবং প্রযোজ্য সংশোধন বিষয়াদি, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যাবলি তদারকি, নির্বাচনি কর্মকর্তা/ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি ও সমন্বয়।
দেশের বাইরে ভোটদান এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সম্পর্কিত কার্যাবলি সমন্বয় কমিটি এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সম্পর্কিত কার্যাবলি সমন্বয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহকে। কমিটির সদস্য হলেন- ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব (নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২), উপসচিব (নির্বাচন সহায়তা ও সরবরাহ), পরিচালক (জনসংযোগ) ও সিস্টেম ম্যানেজার (আইসিটি)।
এই কমিটির কার্যপরিধি হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের ভোটাধিকার প্রদানের পদ্ধতি প্রণয়ন; প্রবাসীদের ভোট প্রদান সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সমন্বয়; প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থাগুলোর সঙ্গ সমন্বয়, পর্যবেক্ষক নীতিমালা অনুসারে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয়; এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি।
যা বলছে নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ভোটের দায়িত্বে থাকা মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খল বাহিনীর কার্যক্রমের তদারকি ও সমন্বয় করবে। নির্বাচনে সম্ভাব্য সহিংসতা, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা নিরূপণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর গঠিত ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির কার্যক্রমও তদারকি করবে। নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ কার্যক্রমও মনিটরিং করা হবে।’
সবমিলিয়ে, বিগত কয়েকদিনে ইসির কার্যক্রম এবং তৎপরতায় কমিশনের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচনের প্রস্তুতির ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনি মাঠের বিশ্বাসযোগ্য আবহ তৈরি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। কিন্তু বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ফের সংকটে পড়বে নির্বাচন ব্যবস্থা, যা থেকে উত্তরণ বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। তাই এই অবস্থার উন্নতিতে সরকার ও কমিশনকে একযোগে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।