Monday 14 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি, শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্যে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:০৮

জুলাইয়ের দিনলিপি। ১৪ জুলাই ২০২৪। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ১৪ জুলাই ২০২৪। দিনটি ছিল রোববার। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গর্জে ওঠা দিনগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে এদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহর শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মুখর ছিল। ঢাকায় শত শত শিক্ষার্থী পুলিশের ব্যারিকেড ডিঙিয়ে বঙ্গভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করেন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেন। আর বিকেলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্য ঘিরে ক্ষুব্ধ হয়ে মধ্যরাতেই রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা।

বঙ্গভবন ঘেরাও এবং স্মারকলিপি প্রদান

বিজ্ঞাপন

বেলা ১১টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক অনুযায়ী সেদিন ঘোষিত ছিল বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা। দুপুর ১২টায় পদযাত্রা শুরু হয়। শাহবাগ, মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট— সবখানেই পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা থেমে থাকেননি। ব্যারিকেড ভেঙ্গে ও ডিঙিয়ে এগিয়ে যান গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। সেখানেও প্রতিরোধ। আন্দোলনকারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক দিয়ে বঙ্গভবন যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধের চেষ্টা করে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান ও স্লোগান শেষে শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে অগ্রসর হন।

এর পর পদযাত্রা নিয়ে তারা গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে পৌঁছলে পুলিশ আবারও বাধা দেয়। তখন আন্দোলনকারীরা সামনে অগ্রসর হতে না পেরে সেখানেই বসে পড়েন। এক পর্যায়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে জিরো পয়েন্টের ব্যারিকেড ভেঙ্গে বঙ্গভবনের দিকে অগ্রসর হন শিক্ষার্থীরা। তারা গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের কাছে পৌঁছলে পুলিশ ফের তাদের গতিরোধ করে। সেখানে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানও প্রস্তুত রাখা হয়। এ সময় রাস্তা ব্লক ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। সেখানে এপিসি কার ও জলকামান নিয়ে শত শত পুলিশ সদস্য প্রস্তুত রাখা হয়।

পরে বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যান। প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বিকেল ৩টার দিকে তারা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।

স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীদের দাবি

২০১৮ সালে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত কোটা বিলুপ্তির সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সব গ্রেডে বৈষম্যমূলক কোটার সংস্কার হয়নি। স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন—

* সব গ্রেডে অযৌক্তিক কোটা বাতিল করতে হবে
* সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫% কোটা রাখতে হবে
* কোটা পদ্ধতি আইন করে সংসদে পাস করতে হবে
* আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও মামলা প্রত্যাহার করতে হবে

সারাদেশে একইসুরে প্রতিবাদ

ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেয়। ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীরা দুপুর ১টায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিকেল ৩টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। এ সময়ে আনন্দ মোহন সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

শহরের পুলিশ লাইন্স থেকে বেলা ১১টায় পদযাত্রা নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। এদিন কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংহতি সমাবেশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

১৪ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টায় সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল সিটি কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা পৃথক মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। বংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রংপুর সরকারি কলেজ, কারমাইকেল কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। এ ছাড়া, ঝিনাইদহ, নাটোর, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামের চিলমারীতে পদযাত্রা, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।

শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্যে মধ্যরাতে উত্তাল ঢাবি

১৪ জুলাই বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’ এই বক্তব্য মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১২টার পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মধ্যরাতে নারী ক্যাম্পাস হল থেকে প্রথম শোনা যায় নারী শিক্ষার্থীদের সেই স্লোগান, ‘তুমি কে, আমি কে—রাজাকার রাজাকার’। এর পরই প্রধান ফটকের তালা ভেঙে মধ্যরাতেই রাজপথে নেমে পড়ে নারী শিক্ষার্থীরা। কুয়েত মৈত্রী হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের নেতৃত্বে শুরু হয় বিক্ষোভ।

এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন স্লোগানে মধ্যরাতে ক্যাম্পাস উত্তাল করে তোলেন।— এই স্লোগানে গর্জে ওঠে রাজু ভাস্কর্য চত্বর। এদিন রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কিছু হলে শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। টিএসসি হয়ে মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আবার হলে ফিরে যায়। রাত দেড়টার দিকে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও মিছিলে যোগ দেন। ঢাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে তারা ক্যাম্পাস ঘুরে আবার বুয়েটে ফিরে যায়।

আক্রমণ, পদত্যাগ ও প্রতিরোধ

রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তিন নেতা ফেসবুক পোস্টে সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এদিনই হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা বহালের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। ২৭ পৃষ্ঠার এই রায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও ক্ষোভের জন্ম দেয়।

এদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা না বুঝেই কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে। কোটা আন্দোলনে উসকানিদাতা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মামলা তোলার যতই আল্টিমেটাম দিক, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। মেরিট দেখেই মামলা করা হয়েছে।’

তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন,‘ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ ‘বিএনপি ও সমমনারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য

রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘স্মারকলিপিতে আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪ ঘণ্টার একটি সুপারিশ করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদে অধিবেশন ডেকে আমাদের এক দফা দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা এ বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই।’

আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এটি আমরা আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছি। এর মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করা না হলে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।’

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

১৪ জুলাই ২০২৪ উত্তাল ঢাবি ছাত্র আন্দোলন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর বৈষম্যবিরোধী রাজাকারের নাতিপুতি শেখ হাসিনা স্মারকলিপি

বিজ্ঞাপন

শাকিব খানের ‘মিশন হলিউড’
১৪ জুলাই ২০২৫ ১৬:২০

আরো

সম্পর্কিত খবর