ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্কের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের বৈঠক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো স্বস্তির বার্তা আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা এই শুল্ক না কমলে দেশের পোশাক খাতে বড়ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে ২০০ থেকে ৩০০ পোশাক কারখানা। এ ছাড়া, প্রভাব পড়তে পারে দেশের ছোট-বড় প্রায় দুই হাজারের বেশি পোশাক কারখানায়। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কা ও উদ্বেগে দিন কাটছে এই খাতের উদ্যোক্তাদের।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই দেশের পোশাক রফতানির সবচেয় বড় গন্তব্য। দেশটিতে দেশের পোশাকের ২০ শতাংশ রফতানি হয়ে থাকে। গেল এপ্রিলে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রভাবে দেশটির অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ স্থগিত করে দেয়। পরে পালটা শুল্কারোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হলে ক্রয়াদেশের স্থগিতাদেশ উঠে যায়। ট্রাম্প শুল্কের বিষয়টি জুলাইয়ে আবার সামনে নিয়ে এলে নতুন করে ক্রয়াদেশ স্থগিত হতে থাকে। বেশকিছু পোশাক কারখানার মালিক ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, এরই মধ্যে ওয়ালমার্ট, স্মার্টেক্সসহ কয়েকটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে।
জানতে চাইলে দেশের পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতনিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু শুল্পের পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, ঠিক কী পরিমাণ প্রভাব পড়বে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে শুল্ক যদি ৩৫ শতাংশই থাকে, তাহলে ২০০ থেকে ৩০০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমার বলে ধারণা। প্রকৃত ক্ষতি আসলে কী পরিমাণ হবে, চূড়ান্ত শুল্ক নির্ধারণের পরই তার প্রভাব বুঝা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে এবং তারা আশাবাদী, তাই আমাদের আশাবাদী হওয়া ছাড়া উপায় নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘পোশাকের মোট রফতানির প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়ে থাকে। দেশের প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ কারখানায় যুক্তরাষ্ট্রের কাজ হয়ে থাকে। তবে এসব ফ্যাক্টরি যে পুরো সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাজ করে তা নয়। শুল্কের প্রভাবে এসব কারখানায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রভাবে অনেক কারখানায় ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ার তথ্য এসেছে। অফিসিয়ালি একটি কারখানা আমাদের মেইল করে সেই তথ্য নিশ্চিত করেছে। ফলে আমরা বলতে পারি, এরই মধ্যে একটি কারখানার ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে।’
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া তৈরি পোশাকের বড় একটি অংশ যায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডকে ১০ লাখ সাঁতারের প্যান্টের ক্রয়াদেশ দিয়েছিল, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০ লাখ ডলার। গেল বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি ওই ক্রয়াদেশ স্থগিত করে। ওয়ালমার্টকে এসব পণ্য সরবরাহ করার কথা ছিল ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের। তারাই প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেলকে ই-মেইলে ক্রয়াদেশ স্থগিতের কথা জানায়।
জানতে চাইলে প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ওয়ালমার্টের কাজ করি আমরা। তাদের ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান ক্ল্যাসিক ফ্যাশন। প্রতিষ্ঠানটি আমাদের মেইল করে জানিয়েছি, শুল্ক ইস্যুর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ক্রয়াদেশ স্থগিত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বছরে ৪০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করি। এর মধ্যে ২০ শতাংশ রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। শুল্ক ইস্যুর সমাধান না হলে রফতানিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আর এখন অনেক প্রতিষ্ঠানেরই ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে। এতে আমাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।’
জানতে চাইলে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর আমরা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পোশাক রফতানি করে থাকি। আমার মোট রফতানির প্রায় অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রে। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল না হলেও ক্রেতারা নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন।’
তিনি জানান, ৩৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ১৬. ৫ শতাংশ শুল্ক মিলেয়ে মোট শুল্কভার প্রায় ৫১ শতাংশ। ৫১ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কোনোভাবে পোশাক রফতানি করা কি সম্ভব? ৩৫ শতাংশ শুল্ক থাকলে ২০ থকে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অন্য দেশে তাদের পোশাক উৎপাদন করবে। ৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্রেতা বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদন করাবে না। এরই মধ্যে অনেক ক্রয়াদেশ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। জর্ডান, ইথোপিয়া, কেনিয়া ও মিশরে অনেক ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হবে। কারণ, এসব দেশে পোশাক উৎপাদন করলে শূন্য শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে। এসব দেশের ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক নেই।
তিনি বলেন, ‘যে দেশে শুল্ক সবচেয়ে বেশি কম থাকবে, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পোশাক সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হবে। ক্রেতারা ওই দেশের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবে। কারণ, সেখানে উৎপাদন খরচ কম পড়বে। ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সুবিধা পেলেও তাদের পণ্য উৎপাদনেও শুল্ক থাকবে। ভারতের ক্ষেত্রে হয়তো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক থাকতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের এই শুল্কের প্রভাবে তারাও খুব বেশি উপকৃত হবে না।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশের যেভাবে অলোচনা করার দরকার ছিল, যেভাবে দর কষাকষি করা দরকার ছিল, সেখানে কি তা হচ্ছে? শুল্ক যদি ৩৫ শতাংশই থাকে, তাহলে দেশের পোশাক শিল্পে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।’
পোশাক শিল্পের একজন উদ্যোক্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্পের প্রভাবে সারাবিশ্বই একটি হুমকি পড়েছে। এখনো কোনো দেশের জন্য শুল্ক চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ হয়নি। প্রায় সব দেশই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম ও ভারতের ক্ষেত্রেও শুল্ক নির্ধারণ হয়নি। তবে শুল্ক যদি ৩৫ শতাংশই থাকে দেশের পোশাক শিল্পে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যদি কম সুবিধা পায় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানিতে বড় ধাক্কা লাগতে পারে।’
শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কারখানা ১ হাজার ৫৫৫টি। আর বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত সচল কারখানা ৫৮১টি। ফলে সব মিলিয়ে এই দুই সংগঠনের তালিকাভুক্ত ২ হাজার ১৩৬ টি পোশাক কারখানা উৎপাদনে রয়েছে। তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে শতভাগ পোশাক রফতানি করে ১৬৮টি কারাখানা। ৭০০ থেকে ৮০০ কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে আংশিক বা অর্ধেক পোশাক রফতানি কর থাকে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক না কমলে এসব কারখানার পোশাক রফাতনিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যান্য পোশাক কারখানাও। সামগ্রিকভাবে রফতানি আয়ে ধাক্কা লাগলে দেশের অর্থনীতির টালামাটাল অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।