Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
চট্টগ্রামে প্রথম ‘জুলাই শহিদ’ ওয়াসিম, নিঃশেষে প্রাণ করে গেল দান

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুলাই ২০২৫ ০০:১৬

চট্টগ্রামে প্রথম ‘জুলাই শহিদ’ ওয়াসিম আকরাম। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের হামলা-সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম। একটি মৃত্যু পুরো একটি সাজানো-গোছানো পরিবারকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আকস্মিক সন্তান হারানোর আঘাত সইতে না পেরে শোকস্তব্ধ মা হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি, একবছর ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী তিনি। সৌদিআরবের কর্মস্থল থেকে দেশে এসে আর ফিরতে পারেননি বাবা-ভাই।

আর ছোট দুই বোনের স্মৃতিতে ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ভেসে উঠলে এখনো চোখের জল সম্বরণ করতে পারেন না। দুই বোনকেই ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন ওয়াসিম। মেধাবী দুই বোন ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণের পথেই হাঁটছেন। হয়তো একদিন স্বপ্ন সফল হবে, কিন্তু সেটা আর দেখে যেতে পারবেন না ওয়াসিম।

বিজ্ঞাপন

‘জুলাই বিপ্লবের’ বর্ষপূর্তিতে সারাবাংলার সঙ্গে ওয়াসিম আকরামের বাবা ও ছোট দুই বোনের আলাপে এমন মর্মন্তুদ শোকগাঁথার চিত্র উঠে এসেছে।

ওয়াসিম আকরাম (২৪) চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ ছাড়া, তার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।

তাদের বাড়ি পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ মেহেরনামা গ্রামে। বাবা শফি আলমের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে ওয়াসিম ছিলেন তৃতীয়। মা জ্যোৎস্না বেগম গৃহিণী। বড় বোন মর্জিনা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট দুই বোনের মধ্যে রুশনি আক্তার রুমি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন আর সাবরিনা ইয়াসমিন এবার এসএসসি পাস করেছেন।

ওয়াসিমের বাবা শফি আলম ও বড় ভাই আরশাদ হোসেন ছিলেন সৌদিআরবে। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ২৫ দিনের মাথায় দেশে ফেরেন আরশাদ। আর এক মাস ১৭ দিন পর দেশে ফিরে আসেন শফি। শোকে কাতর শফি-আরশাদ আর ফিরতে পারেননি বিদেশের কর্মস্থলে।

এক বছর পার হতে চললেও এখনো সন্তান হারানো যন্ত্রণা ভুলতে পারছেন না শফি আলম। কথা বলার মানসিক শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলছেন ধীরে ধীরে। কেমন আছেন- জানতে চাইলে শফি আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি গাড়ির চারটি চাকা থাকে। একটি চাকা নষ্ট হয়ে গেলে গাড়ি অচল। আমার পাঁচ সন্তানের মধ্যে একটি সন্তান চলে গেছে। আমিও অচল হয়ে গেছি। কীভাবে আর বিদেশে যাব! আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ভাই হারানোর যন্ত্রণা আমার অন্য সন্তানদের মধ্যে। কেউ আমাকে ছাড়তে চায় না। বাকি জীবনটা তাদের বুকে আগলে রেখেই কাটিয়ে দিতে চাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী, সেটা যে সন্তান হারিয়েছে শুধু সে-ই বুঝবে। মা হারিয়েছি, দুই মাস পর ছেলেকেও হারিয়েছি। আমার আর ভালো থাকার সুযোগ নেই।’

ছোট বোন রুমি এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছিলেন। এত খুশি হয়েছিল ওয়াসিম, এইচএসসিতেও এমন ভালো ফল করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন বোনের কাছ থেকে। এবার এইচএসসি দিচ্ছেন রুমি, কিন্তু সেই ভাই আর পাশে নেই। চোখে জল নিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছেন পরীক্ষার হলে।

চট্টগ্রামে প্রথম ‘জুলাই শহিদ’ ওয়াসিম আকরামের ছবি নিয়েই কাটে কার মায়ের দিন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

চট্টগ্রামে প্রথম ‘জুলাই শহিদ’ ওয়াসিম আকরামের ছবি নিয়েই কাটে কার মায়ের দিন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

রুশনি আক্তার রুমি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দেয়, সেদিন ভাইয়া বাড়িতে ছিল। টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছিল। পাশে বসে ছিল আম্মু। তখন আমি আমার রেজাল্ট জানতে পারি, গোল্ডেন এ-প্লাস পেলাম। খুশিতে আমি ভাইয়া আর আম্মুকে জড়িয়ে ধরি। ভাইয়া কী খুশি যে হয়েছিলেন! আমাকে বলেছিলেন ইন্টারেও এমন ভালো রেজাল্ট করতে হবে। এখন আমি ইন্টার পরীক্ষা দিচ্ছি। ভাইয়ার সেই স্মৃতিটা খুব বেশি মনে পড়ে। খুব মন খারাপ হয়।’

সাবরিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ার আগ্রহে আমরা দুই বোন সাইন্সে পড়াশোনা করছি। ভাইয়া বলেছিল, দুই বোনকে ডাক্তার হতে হবে। সেভাবেই পড়ালেখা করছি। ভাইয়ার স্বপ্ন আমাকে পূরণ করতে হবে।’

পড়ালেখার জন্য চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন ওয়াসিম। গত বছর জুনে ঈদুল আজহার সময় বাড়ি গিয়েছিল, সেই শেষবারের মতো। সাবরিনা জানালেন, আটদিন গ্রামে থেকে শহরে ফিরে ভারতের শিলংয়ে যান সেখানে থাকা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে। তিনদিন পর ফিরে আসেন। এরপর ফোনে যোগাযোগ হলেও ওয়াসিম আর বাড়ি যাননি, একেবারে ১৬ জুলাই রাতে ফিরেছেন লাশ হয়ে।

‘আমার ভাইয়া সালাহউদ্দিন আহমেদ সাহেবের কর্মী ছিলেন। বিএনপি করতেন। এখানে গ্রামেও করতেন, চট্টগ্রাম শহরেও যেখানে বিএনপির মিটিং-মিছিল হতো, সেখানে সামনে থাকতেন। ঢাকায় মিটিং-মিছিলের জন্য চলে যেতেন। আমরা ফেসবুকে সেসব ছবি দেখলে আম্মুকে দেখাতাম। আম্মু বারবার সতর্ক করতেন।’

সাবরিনা বলেন, ’১৫ জুলাই ঢাকায়, চট্টগ্রামে, আরও অনেক জায়গায় গণ্ডগোল হচ্ছিল। ভাইয়ার ছবি ফেসবুকে দেখলাম, আন্দোলনে আছেন। আমার আম্মুকে ছবি দেখালাম। আম্মু ফোন দিলে ভাইয়া বললেন- আম্মু, আমি যদি আন্দোলন করে মরতে পারি, তাহলে শহিদ হবো। আমি যেন শহিদ হতে পারি, সেই দোয়া করবেন। আমার আম্মু কান্না করে দিয়েছিলেন। রাতে ভাইয়া আব্বুকে ফোন করে টাকা খুঁজেন। আব্বু ১৬ তারিখ সকালে টাকা পাঠান।’

১৬ জুলাইয়ের সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেদিন যখন আমার ভাইকে গুলি করা হলো, আহত হওয়ার পরও তার কিছুক্ষণ সেন্স ছিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার সঙ্গে থাকা একজনের হাতে দিয়ে কোডটা খুলে দিল। এরপরই সেন্সলেস হয়ে যায়, বোধহয় প্রাণ চলে যায়। মোবাইলে আমার আম্মুর নম্বর ‘আম্মু’ নামে আর আব্বুর নম্বর ‘ফাদার’ নামে সেভ করা ছিল। ওই লোক আমার আব্বুকে কল দিয়ে বললেন, একটা ছেলে গুলি খেয়েছে, তার মোবাইলে আপনার নম্বর পেয়ে ফোন করেছি। আমার আব্বু হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাতে বললেন।”

‘ছবি যখন পাঠাল, তখন আব্বু চিৎকার দিয়ে উঠল- এটা তো আমার ছেলে ওয়াসিম। উনি নাকি তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর আমার আম্মুকে ফোন করেন। আম্মু চিৎকার করে কান্না করতে করতে বিছানায় পড়ে যান। ঘরে তখন আমরা শুধু দুই বোন। আমাদের পক্ষে তো আর চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে লাশ আনা সম্ভব না। আমার চাচা-চাচী গিয়ে লাশ নিয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে ফেরেন। পরদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ পাহারায় দাফন হয়।’

সন্তান হারিয়ে একবছর ধরে মা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী জানিয়ে সাবরিনা বলেন, ‘আমার মা অনেকটা স্তব্ধ হয়ে গেছেন। বলতে গেলে কথা তেমন বলেনই না। আব্বু আর বড় ভাই দেশে ফেরার পর ডাক্তার দেখিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত আর্তচিৎকারে কানের পর্দা ফেটে গেছে। শ্রবণশক্তি নেই বললেই চলে। আর শোকের কারণে কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।’

দেশের জন্য আন্দোলন করে নিঃশেষে প্রাণ দিয়ে গেছেন ওয়াসিম আকরাম। বীরের এই প্রাণদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ওয়াসিম আকরামের নামে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ ছাড়া, নগরীর আমবাগারে ‘শেখ রাসেল পার্কের’ নাম ‘শহীদ ওয়াসিম আকরাম পার্ক’ করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব প্রথম শহিদ

বিজ্ঞাপন

বরিশালে এনসিপির পদযাত্রা
১৬ জুলাই ২০২৫ ০১:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর