রংপুর: ১৬ জুলাই, ২০২৫। শহিদ আবু সাঈদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের সেই সরল, মেধাবী ছেলেটি, যিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে বুক পেতে দিয়েছিলেন পুলিশের গুলির সামনে, আজ তিনি একটি জাতির প্রেরণার প্রতীক। তার দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর সেই আইকনিক ছবি দেশের দেয়ালে দেয়ালে, হৃদয়ে হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রথম শহিদ, যার রক্ত রাঙানো পথে বাংলাদেশ পেয়েছে স্বৈরাচারমুক্ত নতুন দিন। কিন্তু রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে, মা মনোয়ারা বেগম ও বাবা মকবুল হোসেনের বুক এখনো খালি— শূন্যতার হাহাকারে ভরা।
একটি সাহসী হৃদয়ের বিদায়
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই, দুপুরের কড়া রোদে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পার্ক মোড়ে হাজারো শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তাদের স্লোগানে মুখরিত ছিল রাস্তা। আবু সাঈদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, ছিলেন মিছিলের সামনের সারিতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, পুলিশ টিয়ার গ্যাস আর লাঠিচার্জে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে চাইলেও আবু সাঈদ এক পা-ও পিছু হটেননি। এক হাতে লাঠি, দুই হাত প্রসারিত করে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন— অটল, নির্ভীক।
কিন্তু পরক্ষণেই ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। পুলিশের ছোড়া গুলি তার বুকে, মুখে, ঊরুতে আঘাত হানে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শকের কারণে তিনি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাণ হারান। গুলির চিহ্ন ছিল তার মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত। জাতিসংঘের একটি তথ্য-অনুসন্ধান প্রতিবেদন পরে নিশ্চিত করে, আবু সাঈদের মৃত্যু ছিল ‘প্রাণঘাতী ধাতব গুলি’ দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
আবু সাঈদের সেই প্রতিবাদী ভঙ্গি, দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর ছবি, গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ‘আমার ভাই মরল কেন?’— এই প্রশ্নে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ এক হয়ে ওঠে। তার মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে নতুন গতি দেয়, যা শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিকে এগিয়ে যায়। আবু সাঈদের রক্তে রাঙানো পথই বাংলাদেশকে এনে দেয় নতুন দিশা।
মায়ের বুকের শূন্যতা
রংপুর শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে, পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামের সরু রাস্তা ধরে গেলে চোখে পড়ে আবু সাঈদের বাড়ি। সদ্য নির্মিত ইটের ঘর, গোলাপি রঙের চকচকে দেওয়াল, চওড়া বারান্দা সবই বলে দেয়, এ ঘরে এখন অভাব নেই। কিন্তু ঘরের সামনে দাঁড়ানো মনোয়ারা বেগমের চোখের কোণ ভেজা। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আজ নতুন ঘর হয়েছে, ঘরে টাকাও আসে। কিন্তু আমার ছেলেটা যে নেই! বুক খালি করে চলে গেছে সে।’
আবু সাঈদ ছিলেন মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের নয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে মেধাবী। জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫, রংপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি— তার শিক্ষাজীবন ছিল উজ্জ্বল। অভাবের সংসারে টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন, মায়ের চিকিৎসা থেকে ছোট বোনের আবদার— সবই সামলাতেন।

শহিদ আবু সাঈদের সমাধিস্থল। ছবি: সারাবাংলা
মনোয়ারা বেগমের কণ্ঠ কাঁপে, ‘ওকে কখনো চোখে চোখে রাখতে হয়নি। এত শান্ত, এত বুদ্ধিমান ছিল আমার সাঈদ।’ তিনি জানান, সাঈদ বাড়ি এলে বাজার করে আনতেন, বোন সুমি খাতুনের সঙ্গে মিলে রান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন। কিন্তু সেই স্মৃতি এখন তাকে কষ্ট দেয়। ‘সাঈদের বয়সী ছেলেদের দেখলে মনে হয়, এটা যদি আমার সাঈদ হতো!’
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের কণ্ঠেও আক্ষেপ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সন্তানের হাতে মা-বাবার কবর হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা সন্তানের কবর পাহারা দিচ্ছি।’ ঘরের পেছনে, নরম মাটির নিচে চিরঘুমে শুয়ে আছেন আবু সাঈদ। তার কবরের পাশ দিয়ে বাড়ির সীমানা প্রাচীর টানা হচ্ছে। মনোয়ারা বেগম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সেদিকে।
পরিবারের বর্তমান অবস্থা
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর পরিবারের অবস্থা এখন সচ্ছল। সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা এসেছে। তবে মকবুল হোসেন জানান, সরকারের প্রতিশ্রুত ৩০ লাখ টাকার কোনো খবর এখনো পাননি। আবু সাঈদের দুই ভাই, আবু হোসেন ও রমজান আলী, বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন ব্যক্তিগত কারণে। বড় ভাই আবু রায়হান বিয়ে করে গ্রামে ফিরেছেন, মেজ ভাই আবু হোসেনও গ্রামে স্থায়ী হয়েছেন। ছেলেরা জমি বর্গা দিয়ে ও নানা কাজে যুক্ত হয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তবু মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ঘরে মানুষ আছে, টাকা আছে, শুধু সাঈদ নেই।’
জুলাই শহিদ দিবসে রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি
শহিদ আবু সাঈদ দিবসে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রংপুরে আবু সাঈদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে ‘শহীদ আবু সাঈদ গেইট’ এ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, স্মরণসভা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
একটি জাতির প্রেরণা
তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা জানান, আবু সাঈদের নাম আজ শুধু বাবনপুরের গণ্ডি পেরিয়ে নয়, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তার নামে কবিতা লেখা হয়েছে, ফন্ট তৈরি হয়েছে, রংপুরের পার্ক মোড় এখন ‘আবু সাঈদ চত্বর’।
কিন্তু মনোয়ারা বেগমের কাছে এই সব সম্মান শুধুই সান্ত্বনা। তিনি বলেন, “আন্দোলনের খবর জানলে ফোন করে বলতাম, ‘বাড়ি আয়, বাবা।’ তাহলে হয়তো আমার সাঈদ বেঁচে থাকত।” তার চোখের জল আর কণ্ঠের কাঁপুনি বলে দেয়, কোনো সম্মান, কোনো ঘর, কোনো টাকা সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না।

শহিদ আবু সাঈদের মা-বাবা ও বোন। ছবি: সংগৃহীত
আবু সাঈদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মকবুল হোসেনের কথা যেন সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়: “আমরা সন্তানের কবর পাহারা দিচ্ছি।” তারা জানেন, তাদের ছেলে শুধু তাদের নয়, গোটা জাতির সন্তান। তবু একটি মায়ের বুকের হাহাকার কখনো থামবে না।
শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার এখনো আমি পাই নাই। আমাদের পরিবার শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা কখন আবু সাঈদ হত্যার বিচার পাব।’
তিনি বলেন, দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পেয়েছি। চারজন কারাগারে এবং ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি। শুধু পরোয়ানা জারি করলে হবে না। সারাদেশ ও দেশের বাইরে যেসব খুনি আছে, তাদের দেশে এনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান মঞ্চ সাজিয়ে সেখানে তাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে বিচার করতে হবে।’
রমজান আলী বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষ স্বৈরাচার সরকারের পতনের জন্য জীবন দিয়েছে। সবার চাওয়া হত্যার বিচার ও আহতদের খোঁজখবর নেওয়া। কারণ একমাত্র শহিদ ভাইদের কারণে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।’