Wednesday 16 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে কোটা আন্দোলন ধাবিত হয় গণঅভ্যুত্থানের দিকে

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৩ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫ ০৮:২১

শহিদ আবু সাঈদ। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ১৬ জুলাই ২০২৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। এদিন ফের দেশব্যাপী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পাশাপাশি পুলিশও সেদিন মারমুখী অবস্থানে ছিল।

আবু সাঈদের মৃত্যু ও আন্দোলনের তীব্রতা

এদিন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। আবু সাঈদ সেদিন আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন— যার ছিল না কোনো ঢাল-তলোয়ার অথবা অস্ত্র; ছিল শুধু বুকভরা আত্মবিশ্বাস। সেই বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি সেদিন পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ এ সময় টিয়ারশেল ছুঁড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাঈদ তাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তার দুই হাত ছিল উন্মুক্ত ও প্রসারিত; তিনি বলছিলেন— ‘আমার গায়ে গুলি চালাতে হলে, সামনাসামনি করো।’

বিজ্ঞাপন

এমন সময় মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে শটগানের দু’টি গুলি সরাসরি তার দেহকে বিদীর্ণ করে দেয়। সেই মুহূর্তটাই যেন সময়ের গতি বদলে দিল। ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও ফুটেজে ক্ষোভে ফেটে পড়ল গোটা বাংলাদেশ। আবু সাঈদ হয়ে উঠলেন প্রতিরোধের প্রতীক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হৃদয়।

আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থান: আগুন জ্বলে উঠেছিল ঢাকাসহ সারাদেশে

সাঈদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর থেকেই আন্দোলন হয়ে উঠল আরও সংগঠিত, আরও তীব্র। রাজধানীর রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ঢল নামে— প্রগতি সরণি থেকে শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব থেকে মতিঝিল। ভাটারায় সংঘর্ষ হয় একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে। পুরো দেশে ট্রেন চলাচল ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে, সড়কে নামে স্তব্ধতা।

এদিন চট্টগ্রামে নিহত হন তিনজন, যাদের মধ্যে দুজন ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী, আরেকজন সাধারণ দোকান কর্মচারী। এই আন্দোলন আর কেবল ‘কোটা সংস্কার’ নয়— এটি হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক জবাব।

রাষ্ট্র বনাম নাগরিক শোক যখন প্রতিরোধের রূপ নেয়

সরকার প্রতিক্রিয়ায় বিজিবি মোতায়েন করে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে। আন্দোলনকারীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ এসব পদক্ষেপের মাঝে মানুষ দেখল—সরকার ‘ব্যাকফুটে’ নয়, বরং আগ্রাসী।

হাসনাত আব্দুল্লাহ ও আসিফ মাহমুদের মতো ছাত্রনেতারা উঠে আসেন নেতৃত্বে। হাসনাত আব্দুল্লাহ ওই দিনের দেশব্যাপী সহিংসতাকে ‘রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট দমন-পীড়ন’ হিসেবে আখ্যা দেন। ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা হয়। একইসঙ্গে সাঈদের হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সহিংসতার প্রতিবাদে বিবৃতি দেন ১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক, পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন, এমনকি ১৯৯০-এর ডাকসু নেতারাও।

আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগের তৎপরতা

আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ১৭ জুলাই সকাল থেকে নিজ নিজ ইউনিট অফিসে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। দলটি ঘোষণা দেয়, তারা রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনের মোকাবিলা করবে। একইসঙ্গে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।

এদিকে, সরকার এদিনই কোটা বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্টে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দাখিল করে। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে জমা দেওয়া এ আবেদনে বলা হয়, কোটা রাখা বা না রাখার বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এতে আদালতের হস্তক্ষেপ চলতে পারে না।

আন্দোলনে বিএনপির সংহতি

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এদিন দেশের সাধারণ মানুষ ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয়।

একজন সাঈদের মৃত্যু, লাখো তরুণের জেগে ওঠা

আবু সাঈদের শেষ মুহূর্তের সেই দৃশ্যটি ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়ে গেছে— যেখানে এক তরুণ বুক পেতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আমাকে গুলি করো, কিন্তু অন্যায়কে রক্ষা কোরো না।’ তার মৃত্যু এই প্রজন্মকে ভয় নয়, বরং আশা ও সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা দেশজুড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। এই ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে দুই যুবক নিহত হন।

১৬ জুলাই এখন আর কেবল শোকের দিন নয়— এটি এখন জেগে ওঠার প্রতীক। একটি জাতি যখন চোখে চোখ রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন ইতিহাস রচিত হয় বুকের রক্ত দিয়ে। ২০২৪ এর ১৬ জুলাই তেমন-ই একটি ঐতিহাসিক দিন।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

১৬ জুলাই ২০২৪ আবু সাঈদ হত্যাকণ্ড গণঅভ্যুত্থান জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর