Wednesday 16 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
‘ছেলের কপালে শেষ আদর’— ঘুমোতে দেয় না শান্ত’র বাবাকে

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুলাই ২০২৫ ১০:০৩

শহিদ ফয়সালের মা কোহিনূর বেগম। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে শহিদ হয়েছেন শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। তার বাবা থাকেন বরিশালে বাড়িতে। আর চাকরিজীবী মা ও ছোট বোনের সঙ্গে শান্ত থাকতেন চট্টগ্রাম শহরে। সেবার ঈদের ছুটি শেষে বরিশাল থেকে শান্তরা চট্টগ্রামে ফিরছিলেন। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে তিনি শান্ত’র কপালে চুমু খেয়ে আদর করে দেন। সেই শেষ দেখা, শেষ আদর।

এরপর শান্ত’র বাবা যখন আবার ছেলেকে দেখেন, তখন তিনি কফিনবন্দী, সবাই তার আদরের ছেলেটিকে বলছে ‘লাশ’, লাশ নামাও-লাশ তোলো। নিজের হাতে ছেলেকে মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়েছেন। সেই দুঃসহ সময়ের একবছর পার হচ্ছে। কিন্তু ছেলের কপালে এঁকে দেওয়া সেই শেষ চুমুর স্মুতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শান্ত’র বাবাকে, এখনও ঘুমোতে পারছেন না তিনি।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজারের বাসায় সারাবাংলা’র সঙ্গে আলাপে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন স্মৃতির বর্ণনা দেন শান্ত’র বাবা জাকির হোসেন।

গত বছরের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২০) নিহত হন। তাদের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে। বাবা জাকির হোসেন ফার্নিচার ব্যবসায়ী, মা কোহিনূর বেগম স্কুল শিক্ষিকা। স্কুলপড়ুয়া ছোট এক বোন আছে।

জাকির হোসেন বরিশালে থেকেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। আর কোহিনূর বেগম চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। শান্ত নগরীর ওমরগণি এমইএস কলেজের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

যে বাসার রঙিন দেয়াল, কার্নিশ, জানাল-দরোজা, পর্দা-বিছানা, পড়ার টেবিল- সবকিছুতেই শান্ত’র স্মৃতি লেগে আছে, সেই বাসায় শান্তকে ছেড়ে আর থাকতে পারেননি বাবা-মা, বোন। নগরীর লালখান বাজারে ভাড়া বাসায় উঠে এখন শান্ত’র স্মৃতি হাতড়ে দিন কাটে তাদের। ‘জুলাই বিপ্লবের’ বর্ষপূর্তিতে সেই বাসাতেই সম্প্রতি সারাবাংলা’র সঙ্গে কথা বলেন তার বাবা।

গত বছরের জুনে ঈদ করার জন্য বরিশালে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন শান্ত ও তার মা-বোন। সচরাচর ছেলে-মেয়েকে কখনও তেমন শাসন করতেন না জাকির। কিন্তু বরিশালে মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পান খাওয়ায় শান্তকে একটু বকেছিলেন। বকা শুনে হেসেছিল শান্ত, দেখে জাকিরের মনে হয়েছিল ‘খুব কষ্টের হাসি’। ছেলের সেই হাসিমাখা ‘মলিন’ মুখ তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ২৭ জুন চট্টগ্রামে ফেরত আসছিলেন শান্তরা। সেই ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা জাকিরের।

শহিদ ফয়সালের বাবা জাকির হোসেন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

শহিদ ফয়সালের বাবা জাকির হোসেন। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

তিনি বলেন, ‘২৭ জুন, যেদিন ওরা চট্টগ্রামে ফিরে আসছিল, আমি ওর (শান্ত) কপালে চুমু দিই। তখন আমার ওর হাসিটা মনে পড়ে। কেন জানি, আমি কান্না করে দিলাম! হয়তো সে চলে যাবে চিরতরে, তাই এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমার মেয়ে বলল- আব্বু তুমি কান্না করছো কেন? আমার কান্না আর থামে না। সেটাই শেষ দেখা, ছেলের কপালে শেষ চুমু, শেষ আদর- এটা আমাকে কোনোমতে শান্তি দিচ্ছে না, রাতে ‍ঘুমাতে পারি না, হাঁটতে-বসতে সবসময় মনে পড়ে।’

‘হয়তো সে শহিদ হয়ে যাবে, সেজন্যই আমার এত কষ্ট লাগছিল, সেজন্য হয়তো আমার কান্না পেয়েছিল। আমি অনেকসময় একা একা কান্না করি। রাতে ঘুমানোর সময় কান্না করি। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, এটা অনেক ভারী একটা জিনিস, যার হয়েছে সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমরা ছেলেকে হারিয়ে একটা বছর যে কাটাচ্ছি, সেটা কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, কীভাবে কাটাচ্ছি, একমাত্র আমরাই বুঝি।’

শান্ত’র মা কোহিনূর বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, ‘আমার ছেলে আমার বুকের ধন ছিল। ওকে আমি কোনো কাজ করতে দিতাম না। গোসলের পর বাথরুমে লুঙ্গিটা রেখে দিতে বলতাম। এক গ্লাস পানিও কখনো তাকে ঢেলে খেতে দিইনি। আমার ছেলের কষ্ট হবে, এজন্য আমি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে কোনো কাজে হাত দিতে দিতাম না। আমার ছেলেটাকে ছেড়ে আমাকে একটা বছর কাটাতে হচ্ছে, সারাজীবন কাটাতে হবে, এ দুঃখ আমি কীভাবে সইব!’

মৃত্যুর দু’দিন আগে ১৪ জুলাই শান্ত’র সঙ্গে মোবাইলে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল জাকির হোসেনের। ঘটনার দিনের বর্ণনা তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে গণ্ডগোল হচ্ছে, এটা জানতাম। শান্ত ১৪ তারিখ ফোনে আমাকে বলেছিল। ১৬ তারিখ দুপুরে তার মা আমার মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিল। ফেরার সময় বাসার সামনে দেখা, তখন মাকে সে বলেছিল-মুরাদপুর যাচ্ছে, কাজ আছে।’

‘রাতে আমাকে একজন ফোন করে বলল- আঙ্কেল আপনি তাড়াতাড়ি চট্টগ্রামে আসেন, শান্তকে নিয়ে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। পরে আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ফোন করে আমাকে জানায়, শান্ত শহিদ হয়েছে। আমাকে বরিশালে থাকতে বলা হয়, তারা লাশ নিয়ে বরিশালে যাচ্ছে, এটা বলল। আমি বরিশাল-ঢাকা রোডের মাওয়া পর্যন্ত এসেছিলাম। এটা শুনে আমি আবার বরিশালে ফেরত যাই। তারপর লাশ নিয়ে গেল বরিশালে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে কবর দিলাম।’

ফয়সাল আহমেদ শান্ত’র ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা আছে- ‘যে হৃদয় শাহাদাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করে, সে হৃদয় কখনো হতাশ হয় না।’ শান্ত নেই, কিন্তু সেই লেখা এখনো রয়ে গেছে। জাকির বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ধার্মিক ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। হয়তো তার শাহাদাৎ বরণেরই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, সেজন্যই সে দেশের জন্য জীবন দিল। ফেসবুকে তার লেখাটা আমরা ফ্রেমে বাঁধিয়ে জুলাই জাদুঘরের জন্য দিয়েছি।’

ফয়সাল আহমেদ শান্ত শহিদ হওয়ার পর ইসলামী ছাত্রশিবির, চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ শাখার ফেসবুক পেইজে দাবি করা হয়, শান্ত সংগঠনটির সাথী ছিলেন এবং স্কুল-পশ্চিম ওয়ার্ডের ওয়ার্ড সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সংগঠনের নির্দেশে তিনি ১৬ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবির মিছিলে শরিক হয়েছিলেন।

তবে শান্ত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না সেটা জানতেন না তার পরিবারের সদস্যরা। জাকির হোসেন বলেন, ‘তার (শান্ত) ফেসবুকে রাজনৈতিক কোনো কথাবার্তা ছিল না। বিভিন্ন ধর্মীয় পোস্ট সে সবসময় দিত। শুধু আন্দোলনের সময় ঢাকায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নিরীহ মেয়েদের ওপর যে হামলা করেছিল, সেটার প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দিয়েছিল। এখন ভেতরে যদি তার কোনো রাজনৈতিক চিন্তা বা সমর্থন থাকে বা সে কোনো পার্টির সদস্য হয়ে থাকে, হয়তো ছিল, কিন্তু সেটা আমরা জানতাম না।’

জুলাই বিপ্লবের শহিদদের বিচারকাজ নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেন জাকির হোসেন। নির্বাচনের আগেই যাতে বিচার শেষ হয়, এ দাবি জানান তিনি। জাকির হোসেন বলেন, ‘বিচারকার্যে তো কোনো অগ্রগতি নেই। যারা বিচার করবে, তারা নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নানা ঝামেলা করে, যারা আন্দোলনকারী তারাও নানা ঝামেলা করে। সরকার বিচার করবে কিভাবে? বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ১০ পারসেন্টের মতো হয়েছে, ৯০ পারসেন্ট বাকি। এটা নিয়ে আসলে আমাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। আমাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা আমরা দেখছি না। এখন দরকার যত দ্রুত সম্ভব হত্যাকারীদের বিচার করা, রায় কার্যকর করা।’

‘এর মধ্যে নির্বাচন হয়ে গেলে, আরেক সমস্যা হবে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তখন বিচার হবে কি হবে না, এটাও একটা বিষয় আছে। আমরা ছেলে হারিয়েছি। তখন দেখব যে, আমরাও শিকার হচ্ছি নানাভাবে। কারণ, বিচার না হলে তো তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমরা আশা করি, যারা জুলাইতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের বিচারটা যেন আমরা দেখতে পাই। তাহলে মনে একটু শান্তি পাব।’

শান্তকে নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের কথাও বললেন তিনি। ‘১৬ জুলাই ফয়সাল আহমেদ শান্ত, ওয়াসিম আকরাম, ফারুক এই তিনজন শহিদ হন। উনাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যিনি মেয়র হয়েছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শাহাদাত সাহেব, তিনি সবসময় ওয়াসিমের কথা বলেন শুধু, বাকি দুজনের কথা বলেনই না। আমি মনে করি, এটা একটা বৈষম্য। আমার ছেলে তো দেশের জন্য শহিদ হয়েছেন, তাকে একটু স্মরণ করলে আমরা মনে শান্তি পাই, এটুকু আর কী !’

জাকির হোসেন জানান, শহিদ পরিবারের জন্য সরকারিভাবে ঘোষিত ত্রিশ লাখ টাকার মধ্যে দশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তিনি পেয়েছেন। আরও বিশ লাখ টাকা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পাবার আশ্বাস পেয়েছেন। মাসিক ভাতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

১৬ জুলাই ২০২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব জুলাইয়ের দিনলিপি ফয়সাল আহমেদ শান্ত শহিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর