চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। আগের দিন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা করতে এসে পিছু হটা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এদিন রণমূর্তি ধারণ করে। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগের আরও সশস্ত্র নেতাকর্মী সংঘবদ্ধ হয়ে হামলে পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর। সেদিন হাজারো শিক্ষার্থীও ছাড় দেয়নি, শুরু হয় মরণপণ লড়াই।
তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড় থেকে ষোলশহর-মুরাদপুর এবং আশপাশের এলাকা। প্রাণ হারায় তিনজন। ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিবিরকর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও দোকানকর্মী মো. ফারুক- এই তিন প্রাণের বিনিময়ে সেদিন থেকে চট্টগ্রামে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। দলে দলে সাধারণ মানুষও আন্দোলনে শরিক হতে থাকেন। একটানা তুমুল আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।
সেদিনের আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানান, সেদিনের আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে সেদিন হামলাকারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা পরাস্ত হয়ে একটি ভবনে আশ্রয় নিলে সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় প্রায় সব হামলাকারী দ্বিগ্বিবিদিক পালিয়ে যায়।

সেদিন হামলাকারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের ছাড় দেয়নি হাজারো শিক্ষার্থী, শুরু হয় মরণপণ লড়াই। ছবি: সারাবাংলা

হামলাকারীরা দ্বিগ্বিবিদিক পালিয়ে যায়, খুশিতে সাহস নিয়ে এগোয় ছাত্র-জনতা। ছবি: সারাবাংলা
চট্টগ্রাম নগরীতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগঠিত করতে যাদের মূল ভূমিকা ছিল, তাদের মধ্যে আছেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খান তালাত মাহমুদ রাফি, রাসেল আহমেদ, ছাত্র ফেডারেশনের নেতা আরিফ মঈনউদ্দিন ও ইমন সৈয়দ, ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেত্রী পুষ্পিতা নাথসহ আরও বেশ কয়েকজন।
আগের দিন ১৫ জুলাই বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর হামলার মুখে পড়েছিলেন। সেদিনও শিক্ষার্থীদের পালটা আক্রমণের মুখে তারা ব্যর্থ হয়। এরপর আন্দোলনকারীদের মূল অংশ পরদিন আরও বেশি সংগঠিত হয়ে এবং ছাত্রলীগকে প্রতিরোধের শপথ নিয়ে বিক্ষোভে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন নেতা ও বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের সমন্বয়ক আরিফ মঈনউদ্দিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫ জুলাইয়ের কর্মসূচি শেষ করার পর থেকে তারা নানাভাবে হুমকি পাচ্ছিলেন। নুরুল আজিম রনি ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন।
‘নুরুল আজিম রনি প্রথমে পোস্ট দেন। এরপর ছাত্রলীগের আরও অনেক নেতাকর্মী ফেসবুকে ‘মেরে ফেলব, কেটে ফেলব’–এ ধরনের নানা কথাবার্তা লেখা শুরু করে। জিইসি মোড়ে মার্কেটে-দোকানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্র রাখার ছবি তুলে রাতে অনেকে আমাদের কাছে পাঠায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যাতে ভয় পেয়ে ষোলশহরে আর না যাই। কিন্তু আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ছাত্রলীগ হামলা করতে এলে জোরালোভাবে প্রতিরোধ করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘১৬ জুলাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে দেখি ষোলশহর এলাকায় ছাত্রলীগের ছেলেরা স্লোগান দিচ্ছে, মিছিল করছে। আমাদের প্রিপারেশন ছিল, যেভাবেই হোক আমরা ষোলশহর রেলস্টেশনে জমায়েত হব। কিন্তু খান তালাত মাহমুদ রাফির পরপর তিনটা ফেসবুকের স্ট্যাটাসের কারণে আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। রাফি প্রথমে দুই নম্বর গেট, এরপর মুরাদপুর এবং পরে ষোলশহরে জমায়েত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্ট্যাটাস দেয়। এতে আমাদের জমায়েতগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
প্রতিদিনের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে ১৬ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে জমায়েত হতে থাকেন। তবে দুপুরের আগেই ছাত্রলীগের একাংশ নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে গিয়ে অবস্থান নেয়, যাদের মধ্যে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের নেতাকর্মীরা ছিলেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল আজিম রনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সদস্য আরশেদুল আলম বাচ্চু ও নগর ছাত্রলীগের সাধারণ জাকারিয়া দস্তগীরের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ বিকেল ৩টার দিকে নগরীর দুই নম্বর গেইট এলাকায় অবস্থান নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী, বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উভয়পক্ষের ধাওয়া পালটা ধাওয়া, হামলা পালটা হামলা, গোলাগুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। এর মধ্যে তিনদিক থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মিছিল মুরাদপুরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বেস্টনি দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তখন মাইক্রোবাসে করে যুবলীগের একদল নেতাকর্মী অস্ত্র নিয়ে মুরাদপুরে পৌঁছায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধ প্রতিরোধ দেখে তারা পিছু হটে। শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে প্রাণভয়ে হামলাকারীদের একাংশ মুরাদপুরে বেলাল মসজিদের পাশে মিরদাদ ম্যানশন নামে একটি পাঁচতলা ভবনের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।
আন্দোলনকারীদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, ১৫ জুলাইয়ের মতো পরদিনও প্রথম মিছিল শুরু করে চট্টগ্রামের বেসরকারি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) শিক্ষার্থীরা। তারা দুই নম্বর গেইট থেকে মিছিল নিয়ে জিইসি মোড়ের দিকে যায়। বাটা গলির সামনে ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ‘ধর ধর, শিবির শিবির’বলে আটকে ফেলে মারধর করে। কয়েকজন আহত হয়ে টেক্সটাইল মোড়ে মেরিন সিটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়। সেখানেও তাদের ওপর হামলা হয়।

উভয়পক্ষের ধাওয়া পালটা ধাওয়ায় আহত একজন। ছবি: সারাবাংলা

ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলাকারীরা তিনদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে। ছবি: সারাবাংলা
আরিফ মঈনউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুপুর আড়াইটার দিকে আমি আর সাইফুর রূদ্র (ছাত্র ফেডারেশন নেতা) মুরাদপুরে গেলাম। সেখানে দেখি ছাত্রদলের ওয়াসিম ভাইয়ের নেতৃত্বে অবস্থান চলছে। সেখানে তখন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তিনদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে। প্রথম আক্রমণেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ওয়াসিম ভাই শহিদ হন। উনি চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ। আশপাশের বিভিন্ন ভবন থেকে সন্ত্রাসীরা আমাদের লক্ষ্য করে ফায়ার ওপেন করে। ততক্ষণে হাজার, হাজার আন্দোলনকারীর জমায়েত তৈরি হয়ে যায়। তবে তাদের আক্রমণের মুখে আমরা প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের একটা গ্রুপ শুল্কবহরের দিকে চলে যাই। আমরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল নিয়ে মুরাদপুরের দিকে এগোতে থাকি। বহদ্দারহাট থেকে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা বিশাল মিছিল নিয়ে আসেন।’
‘তখন আমরা সবাই মিলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের পালটা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করি। তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে মুরাদপুর মোড়টা উদ্ধার করে শক্ত অবস্থান নিই। আন্দোলনকারীদের চতুর্মুখী প্রতিরোধের কারণে সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদপুর, আতুরার ডিপোর দিকে চলে যায়। এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে হামলা, পালটা হামলা চলে। সেদিন মুরাদপুর, ষোলশহরসহ পুরো এলাকা একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। সামনাসামনি যুদ্ধ কীভাবে হয়, নিজে একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে তার সাক্ষী হয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন পুরো বাংলাদেশে ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে তিনজন চট্টগ্রামে শহিদ হন। ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও মো. ফারুক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এই প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর তো আন্দোলন আরও তুঙ্গে উঠে, একপর্যায়ে সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর আর নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে সেদিন মূল হামলার ঘটনাটা ঘটেছিল।’

চট্টগ্রামে শহিদ হন তিনজন জুলাই যোদ্ধা। ছবি: সারাবাংলা

শহিদদের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া, কান্নায় ভেঙে পড়ে পরিবার-স্বজনেরা। ছবি: সারাবাংলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সরকারি সিটি কলেজ শাখার সমন্বয়ক নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলার মূল নির্দেশদাতা, মূল গডফাদার ছিল মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তার নির্দেশে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর আর নুরুল আজিম রনি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের জড়ো করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু করেছিল। তবে সেদিন আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। হাজার, হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে মুরাদপুরে একটা ভবনে আশ্রয় নেয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা গিয়ে হামলাকারী অনেককে কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করে।’
সেদিন পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সেদিন নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল। একেবারে নীরব ছিল। আমরা পুলিশকে বলেছিলাম, আমাদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করছে, আপনারা প্রতিরোধ করছেন না কেন ? পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ওপর থেকে নাকি অনুমতি ছিল না।’

সেদিন পুলিশ ছিল একেবারে নিরব দর্শক। ছবি: সারাবাংলা
উল্লেখ্য, ১৬ জুলাইয়ের সংঘাতের পরদিন মুরাদপুর এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন সিএমপি কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি সেই সময় সাংবাদিকদের কাছে সংঘাতের জন্য ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকার সাইফুলকে বরখাস্ত করে। এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়।