ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই রাতে রাজাকার রাজাকার শ্লোগানের পর জুলাই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তবে মূলত ১৫ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা এবং ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শহিদ হওয়ার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। এই আন্দোলন শুধু দেশেই থেমে থাকেনি। ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। যেখানে যেখানে বাংলাদেশি রয়েছে সেখানেই আন্দোলনে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ এমন কোনো দেশ নাই যেখানে আবু সাঈদ হত্যার প্রতিবাদ হয়নি। এমনকি কোথাও কোথাও প্রতিবাদ মিছিল করার অপরাধে প্রবাসী বাঙ্গালীদের গ্রেফতারও করা হয়।
জুলাই আন্দোলন করা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৪ জুলাই বিকেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা কোটা পাবে না তো যতসব রাজাকারের নাতি পুতিরাই মেধাবী তারাই চাকরি নিবে। ওই দিন রাতেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ফেটে পড়ে। একই দিন রাতে শাহবাগে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ জড়ো হয়। তারা এইসব রাজাকার শ্লোগানধারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। পরদিন সকালে কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও মাত্র ৮ থেকে ১০ জন ছাড়া আর কেউ উপস্থিত হননি। ফলে সেই আন্দোলন সেখানেই স্তিমিত হয়।
১৫ জুলাই সকাল বেলা রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেন, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মোকাবিলা করবে। ছাত্রলীগ সারাদেশে আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
এরপর বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হেলমেট পড়ে হকিস্টিক, লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং পিস্তল নিয়ে হামলা শুরু করে। এমনকি ছাত্রলীগ নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও বেধরক মারধর করে। রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। সারাদেশে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।
১৬ জুলাই ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মাঠে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কোটা সংস্কার চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওইদিন দুপুরের দিকে রংপুর থেকে প্রথম মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দেয়। তার দাবি ছিল, তোমরা আমার ভাই বোনদের ওপর হামলা করেছো। দাবি মেনে নাও না হলে এই বুকে গুলি করে মেরে ফেলো। পর পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি চালালে আবু সাঈদ শহিদ হয়। আবু সাঈদের শহিদ হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ ঘোষণা করে।
আজ সেই আন্দোলনের এক বছর পূর্তি হয়েছে। আবু সাঈদের পাশাপাশি মুগ্ধসহ প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন শহিদ হন। আহত হন অন্তত ৩০ হাজারের মতো। আবু সাঈদ নেই, মুগ্ধ নেই নেই হাজারও সন্তান। মায়ের কোল খালি হয়েছে, নতুন সরকার এসেছে, স্বৈরাচার পালিয়েছে, নতুন দল তৈরি হয়েছে, সামনে নির্বাচনের জন্য সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে কি আদৌ মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরে এসেছে, চাঁদাবাজি কি বন্ধ হয়েছে, বৈষম্য কি দূর হয়েছে, ন্যায় বিচার কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সাধারণ মানুষের চাওয়া এত প্রাণের বিনিময়ে দেশটা যেন সুন্দরভাবে চলে।