Wednesday 16 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাজারো প্রাণের বলিদান— অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করল চট্টগ্রামবাসী

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ জুলাই ২০২৫ ২১:৫৫ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫ ২৩:০৩

উত্তাল সময়ের তথ্যচিত্র। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সন্ধ্যা নেমেছে কেবল। চট্টগ্রাম জেলা স্টেডিয়ামের মাঠজুড়ে হাজারো কিশোর-তরুণসহ নানা বয়সী মানুষের সমাগম। অতিথির আসনে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ বিশিষ্টজনেরা। আলো-আঁধারি মঞ্চে শহিদের স্বজনদের আবেগমথিত কথামালা, আহতদের কান্নাজড়িত স্মৃতিকথা, উত্তাল সময়ের তথ্যচিত্র, অনুপ্রেরণাদায়ী গান- সব মিলিয়ে স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন যেন হয়ে উঠেছিল ‘চব্বিশের জুলাইয়ের সেই রণাঙ্গন’।

বুধবার (১৬ জুলাই) বিকেল থেকেই স্টেডিয়ামে ‘জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা’ দেখতে সমাগম শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত আছেন।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশপথে ছিল ‘খুনি’ আখ্যায়িত করে লাগানো জুলাই আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীপরিষদের ছবি। এ ছাড়াও ছিল জুলাই আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে সেই আন্দোলনে নির্মমতার চিত্র নিয়ে পোস্টার প্রদর্শনী।

অতিথির আসন থেকে উপস্থাপক মঞ্চে ডেকে নেন গত বছরের এদিনে চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনে শহিদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত’র মা কোহিনুর বেগমকে। তাকে ‘শহীদ জননী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।

সন্তানহারা কোহিনূর বেগম সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তার অনুভূতি তুলে ধরেন এভাবে- ‘আমি রান্না করছিলাম, এমন সময় ওর (শান্ত) দুইটা বন্ধু আসে বাসায়। ওরা খুব স্বাভাবিক ছিল, ওরা জানতো যে আমার শান্তমণি আর নেই। আমাকে বলছে, আন্টি, আপনি রেডি হন, একটু মেডিকেলে যেতে হবে, শান্ত গুলি খেয়েছে। আমি বললাম- তোমরা এসব কী বলছো !’

‘আমি তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে মেডিকেলে যাই। পাঁচলাইশ থানার ওসি বলছে- শান্ত’র মা কই? আমি গেলাম, নাম-ঠিকানা সব দিলাম। আমি ভেবেছিলাম, শান্তমণি বেঁচে আছে। বললাম, আমাকে শান্তমণির কাছে নিয়ে যাও। কেউ নিচ্ছে না। মিডিয়ার লোকজন আমার দিকে আসতে থাকে। অনেককে ফিসফাস করতে দেখলাম। কিছু না বলে আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েকটা পেপারে সাইন নেওয়া হলো। আমি তো জানতাম না, এগুলো পোস্টমর্টেমের কাগজ। থানায় কিছুক্ষণ থাকার পর বুঝলাম, আমার শান্তমণি আর নেই।’

চট্টগ্রাম জেলা স্টেডিয়ামের মাঠজুড়ে হাজারো কিশোর-তরুণসহ নানা বয়সী মানুষের সমাগম। ছবি: সারাবাংলা

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কোহিনূর বলেন, ‘মেহমান আসলে তার (শান্ত) সামনে মুরগি জবাই করা যেত না, তার সামনে কোরবানির গরু জবাই করা যেত না। সে রক্ত দেখলে ভয় পেত। আমার সেই ছেলেটা রক্তাক্ত হয়ে মারা গেল। পুলিশকে অনেক অনুরোধ করেছি মরদেহ পোস্টমর্টেম না করার জন্য। পুলিশ শোনেনি। শান্তমণির জন্ম চট্টগ্রামে, পুলিশকে বললাম এখানে যেন একটা জানাজা অন্তত করতে দেয়। ফ্যাসিস্ট সরকার করতে দেয়নি। তারপর পুলিশ পাহারা দিয়ে শান্তমণির মরদেহ বরিশালে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আমার শান্তমণিকে কবর দেওয়া হয়। আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন।’

গত বছরের এদিনে চট্টগ্রামে আরেক শহিদ দোকানকর্মী মো. ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবি তুলললেন খুনিদের কঠিন বিচারের।

সীমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন দুপুরে আমার বাসায় খবর আসে ফারুক নাকি গুলি খেয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি চট্টগ্রাম মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে গেলাম। দেখলাম, আমার স্বামীর দেহটা পড়ে আছে। আমার স্বামী নেই, হঠাৎ করে আমার জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল! আজ আমার জীবন অন্ধকার জীবন। আমি চাই, এভাবে বাংলাদেশে আর যেন কোনোদিন কাউকে জীবন দিতে না হয়। এই স্বৈরাচার আর আমরা বাংলাদেশে দেখতে চাই না। কোথাও যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়, আমার মতো কোনো স্ত্রী যেন বিধবা না হয়।’

‘আমরা চাই একটি সুন্দর দেশ। আমরা স্বৈরাচারের বিচার চাই। যে যেখানে থাকুক, ধরে এনে বিচার করা হোক। গুলি খাওয়ার পর একঘণ্টা ফারুক রাস্তায় পড়ে ছিল। স্বৈরাচারের বাহিনীর গুলির মুখে কেউ তাকে মেডিকেলে নিতে পারেনি। এত নির্মমভাবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে? আপনাদের কাছে আমি বিচার চাই, বিচারটা যেন পরিপূর্ণভাবে হয়।’

গত বছরের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরামের বাবা, মা, বোন, শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। শহিদ শান্তকে নিবেদন করে গান করেন পারাবার শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা।

শহিদ আবরার ফাহাদ, বুয়েটের সেই মেধাবী ছাত্র, যাকে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল নির্মমভাবে, আরেকটি তথ্যচিত্রে তার মা-ভাইয়ের আর্তিও তুলে ধরা হয়। উপস্থাপক আবরার ফাহাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘আবরার ফাহাদ এক সাহসের নাম। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আবরারের সাহসী ভূমিকা দেশের মানুষ চিরদিন স্মরণে রাখবে।’

ফাঁকে ফাঁকে চলছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। জুলাই আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত ‘জুলাই বিষাদসিন্ধু’ চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে জুলাই-আগস্টে দেশজুড়ে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি আহত জুলাই যোদ্ধাদের অনুভূতিও তুলে ধরা হয়। তথ্যচিত্রের শেষে দেশবাসীর জন্য একটি বার্তা দেওয়া হয় – ‘আমরা যেন মনে রাখি শহিদ এবং আহতরা আমাদের দেখছে’।

এদিকে জুলাই আন্দোলনের সময় যে গান আন্দোলিত করেছিল সকলকে, ‘ভুলে যাই আমি, ভুলে যাও তুমি’- সেই গান গেয়ে শোনান পারসা মেহজাবিন। চট্টগ্রামের ব্যান্ডদল ‘রিদম এন্ড প্রীতম’, শিরোনামহীন, শিল্পী এলিটা করিম, র‌্যাপার হান্নানসহ আরও অনেকে আছেন তাদের পরিবেশনার জন্য প্রস্তুত হয়ে। সবশেষে ড্রোন শো-র মধ্য দিয়ে জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা শেষ হবে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এ আয়োজন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

সারাবাংলা/আরডি/এইচআই

চট্টগ্রাম চব্বিশের জুলাইয়ের সেই রণাঙ্গন জুলাই বিপ্লবের এক বছর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর