Thursday 17 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজায় বাধা, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৫ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ১৮:৪৩

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে কফিন মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই। বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাসে এটি এক স্মরণীয় ও বেদনা ভারাক্রান্ত দিন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত গায়েবানা জানাজা এক শোকানুষ্ঠান ছিল। কিন্তু, পুলিশ ও তৎকালীন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) বাধা এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির কঠোর প্রয়োগ সেটিকে এক প্রকার প্রতিরোধের দিনে পরিণত করে।

এদিন পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটির দিনেও সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। কিন্তু জানাজার আগে থেকেই দেখা যায় পুলিশি অবস্থান, ব্যারিকেড, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জানাজার আগ মুহূর্তে পুলিশের আক্রমণে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হলেও বিকেলে উপাচার্য ভবনের সামনে জানাজা সম্পন্ন হয়। এর পর প্রতীকী কফিন হাতে নিয়ে শপথ নেওয়া হয়- ‘এই আন্দোলন বৃথা যেতে দেব না।’

ছাত্রলীগের ওপর পালটা চড়াও

১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাবির অধিকাংশ হলে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। প্রাধ্যক্ষদের কাছ থেকে সই নিয়ে ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ ঘোষণার শপথনামা আদায় করে ছাত্ররা। আর ভোরে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ কর্মীদের হটিয়ে দিয়ে ‘রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস’ ঘোষণা করে।

এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে এবং সন্ধ্যার মধ্যে আবাসিক হল খালির নির্দেশ দেয়। কিন্তু এই নির্দেশ সত্ত্বেও অনেকে ক্যাম্পাসে থেকে যান। বরং তারা কফিন কাঁধে বিক্ষোভ চালাতে থাকেন। এদিন ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় সরকার।

ক্যাম্পাসে গিয়ে ডিবি হারুনের হুমকি

বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ ক্যাম্পাসে গিয়ে হল খালি না করলে ‘কোনো ছাড় দেওয়া হবে না’ বলে হুমকি দেন। তবে আন্দোলনকারীরা জানান, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে এসেছেন, ভয় পেয়ে পিছু হটবেন না।

ইউজিসির তৎপরতা

১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়। জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সব আবাসিক শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন।

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে নিহতদের গায়েবানা জানাজা। ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে নিহতদের গায়েবানা জানাজা। ছবি: সংগৃহীত

সারাদেশে জানাজা ও প্রতিরোধ

চট্টগ্রামের লালদীঘি, রংপুরের পীরগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেটসহ অন্তত ২০টি শহরে গায়েবানা জানাজা হয়। কোথাও পুলিশের বাধা, কোথাও ছাত্রলীগের হামলা। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের গেটে জানাজা করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। রংপুরে শহিদ আবু সাঈদের জানাজা এবং দাফন ঘিরেও ছিল বিপুল জনসমাগম। তার গ্রামের বাড়িতে হাজারো মানুষ জানাজায় অংশ নেয়।

‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ১৮ জুলাই সারাদেশে হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘ছাত্রদের উচিত আদালতের রায় পর্যন্ত ধৈর্য রাখা।’ তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রণমূর্তি ধারণ করে দলীয় কর্মীদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। কাজেই আর বসে থাকার সময় নেই।’

দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হামলা এসেছে, হুমকি এসেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে। কাজেই আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান।’

১৭ জুলাই হয়ে উঠেছিল এক প্রতিশ্রুতির দিন। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রের প্রতি ক্রোধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অদম্য প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে রাষ্ট্র ও ছাত্রসমাজের সংঘাতের এক গভীর রূপক হিসেবে।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই কফিন মিছিল কমপ্লিট শাটডাউন গায়েবানা জানাজা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর