ঢাকা: ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এদিন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে নজিরবিহীন সহিংসতা, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগ। এদিন দেশের বিভিন্নস্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হন। আহত হন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। রক্তে ভেজে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, রংপুর থেকে শুরু করে দেশের অজস্র জেলা ও শহরের রাজপথ।
ঢাকায় দিনভর সংঘর্ষ
ঢাকার রামপুরা, মহাখালী, মিরপুর, মালিবাগ, বাড্ডা, শান্তিনগর, উত্তরা– প্রতিটি জায়গা যেন পরিণত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। এদিন পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দাঁড়ায় ছাত্ররা। হানিফ ফ্লাইওভারে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত হন অনেকেই। মিরপুর-১০ ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশ বক্সে আগুন, উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন দেওয়া এবং সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ ছিল মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিরোধ। বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়া, সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে অগ্নিকাণ্ড শুধু ক্ষোভেরই নয়, বরং দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলাফল বলেও অনেকে মনে করেন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, শুধু ঢাকাতেই ১৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে ১৮ জুলাই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০টি মোটরসাইকেল, ছয়টি বাস, সরকারি অফিস ও দলীয় কার্যালয়। শিক্ষার্থীরা ধাওয়া করলে মেরুল বাড্ডায় পুলিশ সদস্যরা কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নেন, যেখান থেকে তাদের হেলিকপ্টারে সরিয়ে নিতে হয়। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় রাত ৯টার পর। গণযোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে যায়।
‘পানি লাগবে, পানি’- শহিদ হন মীর মুগ্ধ
‘পানি লাগবে কারও?’, ‘পানি লাগবে, পানি’- ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। এর কিছুক্ষণ পর আজমপুর সড়কে তার গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সঙ্গেই ছিল পানির বোতল। তার বন্ধুরা বহু চেষ্টা করেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর রিকশায় করে মুগ্ধকে কাছের ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছবি ও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়।
কোটা ব্যবস্থা বাতিলের শুনানি পিছিয়ে যায়
এদিন সন্ধ্যায় সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য রোববার (২১ জুলাই) দিন ধার্য করে চেম্বার আদালত। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই দিন এ বিষয়ে শুনানি হবে।
ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীর পদত্যাগ
এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া, দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের ২৪ জন নেতাকর্মী দল থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
সরকারের আলোচনার প্রস্তাব, আন্দোলনকারীদের প্রত্যাখ্যান
এদিন জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি সরকার। শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাকে ও শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘গুলির সঙ্গে কোনো সংলাপ হয় না। এই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়।’
সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর দায় সরকারেরই। শহিদের রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হবে না। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে।’
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ
১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ছিল বন্ধ। কিন্তু ব্রডব্যান্ড চালু ছিল। ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সঠিক তথ্য পাচ্ছিল না সাধারণ জনগণ। সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ পলক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।’
আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ
যশোর, রাজবাড়ী, ঝালকাঠি, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, রাঙামাটি, রাজশাহী, সিলেট— কোথাও থেমে থাকেনি জনতার ক্ষোভ। শিক্ষার্থীরা দখলে নেয় মহাসড়ক, বিক্ষোভে উত্তাল হয় শহর। এদিন দেশের ৪৭টি জেলায় সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের।
আওয়ামী নেতারা দুষলেন বিএনপি-জামায়াতকে
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী সারাদেশে এই তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের উসকানির জন্য সারাদেশে কয়েকজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে বসেছে বিএনপি-জামায়াত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আন্দোলন ছিনতাই করেছে তারা।’
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা
পরের দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) সারাদেশে ‘শাটডাউন কর্মসূচি’ অব্যাহত রাখা এবং জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আওয়ামী লীগের ভেতর চাপ বাড়তে থাকে
জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মৌলিক অধিকার।’ একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ, অন্যদিকে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মীর পদত্যাগ— আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেও চাপ বাড়তে থাকে।