Friday 18 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
শাটডাউনে উত্তাল ছিল রংপুর, গণগ্রেফতার উপেক্ষা করে আন্দোলন

রাব্বী হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৮ জুলাই ২০২৫ ১৭:২০

ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

রংপুর: গত বছর ১৮ জুলাই দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে রংপুর ছিল অগ্নিগর্ভ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার জেরে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল নগরী। সেদিন সকাল থেকেই হাজার হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পুলিশের টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও বেপরোয়া লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চালায়, এমনকি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কার্যালয়েও হামলা করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেসময় দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও গুজবের জন্ম দেয়। ১৮ জুলাইয়ের সেই ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করেছেন আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী ও গণমাধ্যমকর্মীরা, যেখানে ফুটে উঠেছে শিক্ষার্থীদের অদম্য লড়াই, পুলিশের দমন-পীড়ন এবং এক থমথমে রংপুরের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

‘কমপ্লিট শাটডাউন’ সফল করতে অনড়

১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ সফল করতে সকাল ১১টা থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থান অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা। রংপুর হয়ে উঠে বিক্ষোভের নগরী। শোক কাটিয়ে উত্তাল হয়ে উঠে আন্দোলন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে পড়েন। সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকারীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নগরীর জিলা স্কুল মোড়ে জড়ো হন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে অবস্থান নেন। প্রায় ৬ হাজার মানুষের এই মিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে পার্ক মোড় হয়ে মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তাজহাট থানা ঘেরাও করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয়। এ সময় আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। বিপরীতে শিক্ষার্থীরা ছোড়ে ইট-পাটকেল। পুলিশের বেড়ধক পিটুনি আর গণগ্রেফতারকে উপেক্ষা করেই আন্দোলন চালিয়ে যান আন্দোলনকারীরা।

বাস চলাচল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ

শিক্ষার্থীদের এমন বিক্ষোভে সড়কে যান চলাচলের পাশাপাশি রাস্তার দুপাশের সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে রংপুর থেকে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার বাস চলাচল। সকাল থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি সেসময়। এমনকি কোনো বাস রংপুরে প্রবেশ করেনি। সেইসঙ্গে আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে রংপুর নগরী ও আশপাশ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি স্থাপনার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কঠোর অবস্থানে নেয় পুলিশ।

আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের অফিসে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ

পুলিশের বেড়ধক পিটুনি আর গণগ্রেফতারের ক্ষোভে আন্দোলনকারীরা সেদিন রংপুরের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালায়। জাহাজ কোম্পানি মোড়, শাপলা চত্বর, পার্ক মোড়, তাজহাট থানা মোড়সহ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দেকে জাহাজ কোম্পানি মোড়ে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি, সিটি টিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর পৌনে ৬টার দিকে জাহাজ কোম্পানি মোড়ের পাশে বাটার গলিতে জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় এবং জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন দেওয়া হয়। এদিকে সন্ধ্যা ৬ টায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা বিশাল মিছিল বের করেন। নগরীর সিটি পার্ক মার্কেট থেকে মিছিলটি শুরু হয়। মিছিল থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিহত শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা।

ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়েন আন্দোলনকারীরা, ছড়িয়ে পড়ে গুজব

কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট কিছুটা ধীর হয়ে আসে। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই বিকেল থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেশজুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এতে যোগাযোগ করতে বিভ্রান্তিতে পড়েন আন্দোলনকারীরা। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আন্দোলন স্থগিত হয়েছে।

আন্দোলনে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ সে সময় ছিলেন সমন্বয়ক। আবু সাঈদ ও সোহাগসহ অন্যান্য নেতারা একসঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৮ জুলাই, আবু সাঈদ ভাই ইতোমধ্যে শহিদ হয়েছেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা রংপুর ভুগছে চরম নেতৃত্বহীনতায়। তাই ১৬ জুলাই খুনিদের গুলিতে শরীরের এক পাশ অর্ধশত গ্রেনেড স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে ঝাঁজরা হলেও এদিনে রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে। কারণ, জারি রাখতে হবে লড়াই! যেকোনো মুহূর্তে গুলিবিদ্ধ, গ্রেফতার ও গুম হওয়ার ভয় ছিল, তবে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল আরও প্রকট!’

তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ ভাই শহিদ হওয়ার পর ‘১ দফা’ ছাড়া আর কোনো সংলাপের রাস্তা খোলা ছিল না। তাই বারবার সংলাপের বিষয় সামনে আসলেও সেসময় উচ্চারণ করেছিলাম ‘শহিদ আবু সাঈদ ভাই যদি আলোচনায় বসতে রাজি হয় তাহলে আমরা সবাই বসতে রাজি হবো, উনি যদি বসতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সংলাপ নাই!।”

১৮ জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করে শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, ‘রংপুর জিলা স্কুল থেকে শহিদ আবু সাইদ চত্বরের দিকে ধেয়ে আসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক বিশাল মিছিল। সেদিন রংপুর মডার্ন মোড় ছিল জনসমুদ্র। একের পর এক বিজয় আসছে কেউ ভয় পাচ্ছে না পুলিশকে।’

বাসা-বাড়ি, ছাত্রবাসে তল্লাশি, দুর্ব্যবহার ও মারধর

পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাসা বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। আন্দোলনকারীরা গ্রেফতার আতঙ্কে মেস, আবাসিক হল ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার খবর পুলিশের কাছে আগে পৌঁছে যায়। এতে করে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্থানে বাসা বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেন পুলিশ। এর আগে ছাত্রাবাস হলগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। অনেক আন্দোলনকারী তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করছেন এমন সংবাদে অভিযান পরিচালনা করলে আন্দোলনকারীদের না পেয়ে স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং মারধরও করেন।

আন্দোলনে সাংবাদিকের বয়ান

১৮ জুলাই ২০২৪ সকাল ৯ টা থেকেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সামনে সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন নাহিদুজ্জামান নাহিদ; তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স এর শিক্ষার্থী এবং একটি গণমাধ্যমে কাজ করতেন সে সময়। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ সফল করতে প্রধান ফটকের সামনেই সকাল ৯ টার পর থেকেই অবস্থান নেন ছাত্র-জনতা। বেলা ১১টা থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে পার্কের মোড়ে আসেন আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়ে উঠে বিক্ষোভের নগরী। যেন আবু সাঈদের আত্মত্যাগ বুকে ধারণ করে দাবি আদায়ে অনড় হয়ে ওঠেন তারা। সেদিন হাজার হাজার মানুষ মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থান নেন। পুলিশের অমানবিক নির্যাতন উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা তাজহাট থানা ঘেরাও করেন। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়ায় অনেকেই আহত হন। আমি নিজেও আহত হই।’

সংক্ষেপে ১৭ জুলাই

১৬ জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। পরদিন ১৭ জুলাই সকালে রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। এর আগে জাফরপাড়া মাদরাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আবু সাঈদের জানাজা ঘিরে মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকে অনেকে জানাজায় অংশ নিতে জাফরপাড়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। এর আগে ১৬ জুলাই রাত ২টার দিকে আবু সাঈদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনবরত চাপ ছিল দ্রুত আবু সাঈদের জানাজা ও দাফন কার্য সম্পন্ন কারার জন্য।

অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ ঘোষণা

পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে ১৭ জুলাই দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

সারাবাংলা/এইচআই

১৮ জুলাই জুলাই বিপ্লবের এক বছর রংপুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর