ঢাকা: দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনের এক বছর। গত বছর এই সময়েই শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল। অন্যায়, নিপীড়ন আর জুলুমের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সেদিন একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তৎকালীন আওয়ামী সরকার এই আন্দোলন দমাতে নিরীহ জনগণের ওপর অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করে। সেই হত্যাযজ্ঞে শিশুসহ কয়েক শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান এবং কয়েক হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
তেমনই একজন জুলাই যোদ্ধা মেহেদী আলম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে পা হারিয়ে তিনি পঙ্গু হয়েছেন। সারাবাংলার প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাইয়ের সেই দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেছেন।
জুলাই যোদ্ধা মেহেদী আলম। ২৬ বছর বয়সী এই যুবকের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে। ঢাকার গুলশানে একটি ফুলের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। গত বছরের ১৮ জুলাই, রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের সামনে শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হন তিনি।
বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। এ পর্যন্ত তার পায়ে ১৫ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। একটি পা পুরোপুরি কেটে ফেলতে হয়েছে এবং অন্য পাটির অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। প্রতিদিন তাকে ২০-২৫টি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হয় তাকে। দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছেন এই জুলাই যোদ্ধা।
১৮ জুলাই সকাল ৬টার দিকে তার মা ফোন করে তাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন, কারণ তিনি একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলেন। মায়ের সেই স্বপ্নই যে এমন ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে, তা হয়তো মেহেদী কখনোই ভাবেননি।
যেভাবে জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হন মেহেদী আলম:
১৮ই জুলাই সকাল থেকেই ইন্টারনেট প্রায় বন্ধ ছিল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলেও খবর দেখতে পাচ্ছিলাম না। বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমি দোকানে কাজ করছিলাম। এরপর যখন চারদিকে কালো ধোঁয়া আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, তখন দোকান বন্ধ করে দিলাম।
বিকেল ৫টার পর লিংক রোডে এসে দেখি পরিচিত সব লোকজনের ভিড়। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা পর্যন্ত ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। তারা জানালো, সারাদিন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাকে এবং আরও অনেককে তারা বললো যে তারা সারাদিন ধরে এখানে আছে এবং আমরা যদি এখন তাদের সঙ্গে যোগ দিই, তাহলে সকালে এসে আবার যোগ দেবে।
এই পরিস্থিতিতে আমি আর আমার বন্ধুরা ভাবলাম, আগামীকাল হয়তো মার্কেট খুলবে না। তাই আমরা রাতে সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দেখলাম প্রচন্ত কালো ধোঁয়া, কিন্তু কোথা থেকে আসছে তা বুঝতে পারছিলাম না। এরপর আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন বাসায় ফিরে গেল।
হঠাৎ করেই আইনশৃঙ্খবাহিনীর গুলি এসে পায়ে লাগে:
সন্ধা ৭টার দিকে যখন রামপুরা আসলাম, তখন দেখি যে রামপুরায় টিভি ভবনে আগুন জ্বলতেছে। সাড়ে ৭টার পরে টিভি ভবনের ভেতরে ঢুকে দেখি খুবই খারাপ অবস্থা এবং এখানে থাকাটাও রিস্ক। তখন ভেতরে যেন কেউ ঢুকতে না পারে সে জন্য সবাইকে বের করে দিয়ে ঢিশ লাইনের তার দিয়ে আমরা গেট বেঁধে দিই। এসময় গুলির শব্দ শুনতে পাই। হাতিরঝিল থেকে গুলি করতে করতে পুলিশ আসতেছে। তখন আমরা লুকিয়ে পড়ি দাঁড়িয়ে থাকা বাসের চিপাচাপায়। তখন হঠাৎ করে বিজিবি ক্লোস ফায়ার শুরু করে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই ফায়ার করতেছে। এমনকি ফ্লাইওভারের ওপর ক্যাম্প করেছিল বিজিবি। এর ১০-১৫ মিনিট পর রাত ৮টার দিকে হঠাৎ করে আমার পায়ে গুলি লাগে। তখন আশেপাশের কয়েকজন ধরে নিয়ে গলির একটি ফার্মেসীতে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো তখন ফার্মেসীতে কিছুই ছিল না। কারণ, সারাদিনে সব ওষুধ অন্য আহতদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে গেছে।
পঙ্গু হাসপাতালে যেভাবে জুলাই আহত মেহেদী আলম:
রামপুরার ডেল্টা হাসপাতালের এক ভাই আমাকে রিকসায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি হাসপাতালে ঢোকার পর দেখলাম গুলিবিদ্ধ আরও কিছু লোক এসেছে এখানে। তাদের মধ্যে নিহতও ছিল। নার্সরা আমাকে গজ পেঁচিয়ে দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন। রিকশায় করে রওয়ানা দেওয়ার পর একটি অ্যাম্বুলেন্স পেলাম, সেটাতে দেখি আরও দুইজন আছেন তারা ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছেন। আমি অনুরোধ করার পর আমাকেও নিয়ে যায়। তখন মগবাজার ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা খুবই ভয়ানক। হাসপাতালে পৌঁছাতে আমার রাত ১১টা বেজে যায়। বুলেট আমার পায়ে একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে চলে গেছে। জরুরি বিভাগ থেকে জানায় পায়ের জন্য ১৪ লাখ টাকা লাগবে। এটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগতেছিল। তখন অন্য কোনো হাসপাতালে সুযোগ না পেয়ে পরদিন শুক্রবার রাত ২টায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে পঙ্গু হাসপাতালে চলে যাই।
পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই চিকিৎসক আমাকে দেখে দ্রুত অপারেশনের কথা বলেন। রাত ২টায় অপারেশনের জন্য সিরিয়াল দিয়ে পরদিন সকাল ১০টায় আমার ডাক আসে। অপারেশনের সময় চিকিৎসকরা আমাকে সাহস জোগাতে থাকেন। এক্স-রে করে দেখা যায়, আমার পায়ের অবস্থা খুবই গুরুতর; বুলেট ছয় ইঞ্চি হাড়, রগ ও মাংস উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ২৭ জুলাই পর্যন্ত আমার চিকিৎসার জন্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, যা আমার আত্মীয়-স্বজনরা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে এতটাই শান্তি পেয়েছিলাম যে আমার সব ব্যথা যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গিয়েছিল:
২৭ জুলাই শেখ হাসিনা আমাদের হাসপাতালে দেখতে যায়। সেখানে প্রত্যেককে একটা করে খাম দিয়ে ছিলেন তিনি। সেই খামে ১০ হাজার করে টাকা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ঘোষণা দেন ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো ছাড়পত্র’। এটা শুনে আমাদের ভেতরে অনেক ভয় কাজ করতেছিল।
৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে পাশের এক রোগী জানান যে সেদিন সংসদ ভবন ও গণভবন ঘেরাও করা হবে। এই কথা শুনে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর ২টার দিকে প্রচণ্ড চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভাঙে। সে সময় “লিল্লাহি তাকবীর” স্লোগান দিয়ে একজন ঘোষণা করেন যে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। এই খবর শুনে আমার মনে এত শান্তি এসেছিল যে সেই মুহূর্তে যেন সব ব্যথা দূর হয়ে গিয়েছিল। এরপর ৬ আগস্ট থেকে আমাদের চিকিৎসার সমস্ত খরচ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়।
হাসিনার বাহিনীর বুলেটে পা হারিয়েও মামলা করেননি মেহেদী:
আমার বালিশের নিচে রাখা ৪-৫টা খাম ছিল, যেখানে শুধু নাম লিখলেই মামলা হয়ে যেত। কিন্তু আমি ভাবলাম, বাড়িতে মা একা, তার ওপর তিনি হার্টের রোগী। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলেও তার দোসররা তো এখনও রয়েছে। যদি তারা আমার মায়ের ওপর হামলা করে, তখন কে তাকে রক্ষা করবে? আমি নিজেও তো তখন পঙ্গু। আমার মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই, পরিবারে আমিই একমাত্র অবলম্বন। এসব চিন্তা করে আর মামলা করা হয়নি।
চিকিৎসার বিষয়ে মেহেদী আলম জানান, সরকার থেকে বি-ক্যাটাগরিতে ১ লাখ টাকা পেয়েছি। আমি ৩০ মিনিটের বেশি বসে থাকতে পারি না। আমার মনে হয়, যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাওয়ার কথা ছিল, তা আমি পাইনি। চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার নার্ভ ও রগ ঠিক হতে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা:
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ যে বিচার সম্ভব, তা হওয়া উচিত। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বিচার একদিন না একদিন হবেই। যদি এই দুনিয়ায় তা নাও হয়, তবে আখেরাতে (পরকালে) এর বিচার অবশ্যই হবে। আমাদের হাত-পায়ের ক্ষত হয়তো একসময় সেরে উঠবে, কিন্তু হৃদয়ের গভীর ক্ষত কোনোদিন মুছে ফেলতে পারব কিনা, তা আমি জানি না।