Saturday 19 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
‘কমপ্লিট শাটডাউন’র দ্বিতীয় দিনে নিহত ৬৭, কারফিউ জারি

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৯ জুলাই ২০২৫ ০৮:০৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। দিনটি ছিল শুক্রবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিন। কারও কারও চোখে এক নতুন গণজাগরণের রক্তাক্ত জন্মদিন। সেইদিন সারাদেশের সড়কগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক, আগুন, প্রতিরোধ এবং প্রবল প্রতিক্রিয়া। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল।

ভোর থেকেই উত্তেজনা, দুপুরে রণক্ষেত্র

দাবি ছিল কোটা সংস্কার। কিন্তু ১৯ জুলাইতে এসে তা আর কেবল একটি দাবির আন্দোলন রইল না— তা রূপ নিল একটি জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলনে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন সকাল থেকেই রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, উত্তরা ও মহাখালীসহ বেশ কিছু এলাকায় সংঘর্ষ শুরু ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতাকর্মীরাও হামলায় অংশ নেয় বলে অভিযোগ উঠে।

বিজ্ঞাপন

শুধু ঢাকা নয়— খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, এমনকি নরসিংদী কারাগার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এই সহিংসতা। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় আগুন, পুলিশের ওপর হামলা, এবং মেট্রোরেল ও রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

মৃত্যুর সংখ্যা ও বিভ্রান্তি

সরকারি কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকলেও নিউ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, এদিন অন্তত ৬৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে ৬২ জন শুধু ঢাকাতেই। অন্যদিকে, কোনো কোনো গণমাধ্যম বলে ঢাকার বাইরে নিহত হন ১২ জন। আহতের সংখ্যা ছিল কয়েকশ, যার মধ্যে সাংবাদিক, পথচারী, পুলিশ, ছাত্র সবাই ছিল। হাসপাতালগুলো গুলিবিদ্ধদের চাপ সামলাতে হিমশিম খায়। অনেক জায়গায় রক্ত মজুত না থাকায় চিকিৎসা ব্যাহত হয়। চিকিৎসকেরা জানান, আহতদের অনেকেই চোখ, বুক ও মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আসে।

রাষ্ট্রের কঠোর প্রতিক্রিয়া, কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন

দিনভর উত্তেজনা চলার পর রাত ১২টার পর সরকার সারা দেশে কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, বিজিবি ও ডিএমপি কমিশনারকে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী। আর রাতেই গ্রেফতার হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ নাহিদ ইসলাম।

এদিন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রামপুরার দিকে ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। যদিও র‍্যাব তা অস্বীকার করে জানায়, তারা কেবল পর্যবেক্ষণ ও উদ্ধার কাজ চালিয়েছেন।

বিআরটিএ, পুলিশ ফাঁড়ি ও মেট্রোরেল: প্রতীকী টার্গেট

বিক্ষোভকারীদের হামলার বিশেষ লক্ষ্য ছিল পুলিশ ফাঁড়ি, বিআরটিএ অফিস এবং প্রশাসনিক ভবনগুলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো প্রতীকী প্রতিরোধের ইঙ্গিত বহন করে। জনগণের অসন্তোষ রাষ্ট্রীয় দমন ব্যবস্থার প্রতীকগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ পেয়েছে।

জনপ্রতিনিধিত্ব বনাম নিপীড়ন

সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য মোকাবিলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ কিন্তু আন্দোলনকারীরা দাবি করছিলেন, তাদের এই লড়াই কোনো দলীয় উদ্দেশ্য নয়, বরং বৈষম্য, দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণ।

‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ ব্যানারে শাহবাগে মানববন্ধন করা হয় অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। এটি আন্দোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।

নতুন কর্মসূচি

এদিন সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন ৯ দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা

১৯ জুলাইয়ের ঘটনায় একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের নগ্ন রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে জনগণের ভয়হীন প্রতিবাদও সামনে এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যূথ্থানের এই অধ্যায় হয়তো ভবিষ্যতে বিচারযোগ্য হবে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে; যেখানে তরুণরা কেবল রাস্তায় নামে নাই, বরং রাষ্ট্রীয় চরম দমন নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বুক পেতে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ছিল, ‘আমরা কেবল চাকরির কোটা চাইনি। আমরা ন্যায় চেয়েছিলাম। আর তার জন্যই আজ এত রক্ত দিতে হচ্ছে।’

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর