Saturday 19 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দুর্বিষহ স্মৃতি
কখনো পা ভাঁজ করতে পারবেন না জুলাই যোদ্ধা রুমেন

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৯ জুলাই ২০২৫ ২৩:০৭

জুলাই আন্দোলনে আহত রুমেন মিয়া। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরোলেও অন্যায়, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ যেন শেষ-ই হচ্ছিল না। মানুষকে পদে পদে শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছিল শাসকগোষ্ঠীর হাতে। আর এই মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছিল। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। মানুষ জেগে উঠল অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। গতবছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ প্রবেশ করল আরেকটি নতুন বন্দোবস্ত দেখার যুগে। আর এই সুযোগ এসেছে তরুণ হাজারো প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে।

তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভিন্নতা হলো- এটি ছিল দেশেরই শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আর এই আন্দোলনে দেশেরই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অত্যাধুনিক গুলি ও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নারী-শিশুসহ হাজারো মানুষ নিহত হন। এ ছাড়া, বুলেটে পঙ্গু হয়ে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ। আর তাদেরই একজন হলেন জুলাই যোদ্ধা রুমেন মিয়া। সারাবাংলার সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন জুলাইয়ের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি।

বিজ্ঞাপন

জুলাই আন্দোলনে আহত রুমেন মিয়া। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। ২৪-এর ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর ধনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে উড়ে যায় তার ডান পায়ের হাঁটুর বাটি। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। আগের মতো আর পা ভাঁজ করে দৌড়াতে পারবেন না রুমেন। মৃত্যু পর্যন্ত এই যন্ত্রণা বয়ে বেরাতে হবে এই জুলাই যোদ্ধাকে।

জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে রুমেন মিয়া বলেন, ‘ছাত্র জনতার ওপর যখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর প্রশাসন, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ একত্র হয়ে হামলা চালানো শুরু করেছিল তখন থেকেই আমি নিজের বিবেক বিবেচনায় আন্দোলনে যোগ দেই।’

গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। জুমআর নামাজ শেষে ধনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার একবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনে যাই। তখন কাজলা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ছাত্র-জনতার দখলে। হঠাৎ করে র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবি গুলি করে। এতে মুহূর্তেই যে যেমনে পারে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। পুরো এলাকা যেন রণক্ষেত্র। এ সময় হেলিকপ্টার থেকেও সাধারণ মানুষের ওপর গুলি করা হয়। তখন হঠাৎ করে আমি পড়ে যাই। আর কীভাবে আমার শরীরে গুলি লেগেছে আমি নিজেও বুঝতে পারি না। কিছু সময় পর আমি উঠলে পুলিশ এসে কাছ থেকে আরেকটা গুলি করে। এর পর আমি আর কিছু বলতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতা আমাকে আহত অবস্থায় সাইমন হাসপাতালে ভর্তি করে। এর পর সেখানেও পুলিশ হামলা করলে ২০ জুলাই সেখান থেকে আমাকে রিলিজ দিয়ে দেয়। এর পর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আমি যাই। সেখানেও যুবলীগ, ছাত্রলীগ হামলা করে। ঢাকা মেডিকেলে আমি শুধু ড্রেসিং করিয়ে দুই দিন পর পঙ্গু হাসপাতালে চলে আসি। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালেই আছি।’

জুলাই আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে রুমেন বলেন, ‘গুলিতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কারও কারও হাড় ভেঙে গেছে। এই ক্ষতি ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। কেউ মন দিয়ে আমাদের চিকিৎসা করে, আবার কেউ করে না। অনেকেই আছে আমাদের দেখতে পারেন না। কিন্তু বাধ্য হয়ে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এই হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসা তেমন একটা দেওয়া হতো না। এমনকি ওষুধও দিত না। নার্স-দারোয়ানকে আলাদা টাকা দিয়ে বাইরে থেকে ব্যাথার ঔষধ আনতে হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসক নাই। এতে আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারতেন, কিন্তু এ কারণে তারা আর পারেননি। সঠিকভাবে চিকিৎসকরা আমাদের খোঁজ খবর নেয় না। ৫ আগস্টের পর সবার দিক থেকে আমাদের সহায়তার যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল সেটা এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের নিজেদেরও ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করা হয়, আমরা যারা জুলাই আহত তারা আরো বিপদে পড়ে যাবে।’

এখন কেমন আছেন?- জানতে চাইলে রুমেন মিয়া বলেন, ‘পায়ের ভেতরে এখনো অনেকগুলো স্প্লিন্টার আছে। সব স্প্লিন্টার বের করা হয়নি। স্প্লিন্টারগুলো তিন দফায় বের করা হয়। বাকি যেগুলো আছে সেগুলো এখন বের করতে গেলে পায়ের কন্ডিশন ঠিক থাকবে না এবং নার্ভ নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা।’

সামনের নির্বাচন নিয়ে মনের কষ্ট প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসার সঠিক ব্যবস্থা না করে সবাই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত আছে। নির্বাচন কবে হবে সেটি নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আগামী মাসে নির্বাচন হলেও আমাদের বলার কিছু নাই। তবে আমাদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছে নির্বাচনের আগে তাদের বিচার করতে হবে। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় আমরা বিচার তেমন একটা দেখতে পাচ্ছি না। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আগে এটা করতে হবে, তারপর নির্বাচন।’

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

১৯ জুলাই ২০২৪ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই যোদ্ধা রুমেন মিয়া