রংপুর: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে গতবছর ১৯ জুলাই আজকের এই দিনে ছাত্র জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল রংপুর মহানগরী। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে ছয়জন নিহত হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ।
সারাদিন যা ঘটে
১৯ জুলাই ২০২৪। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলার মতো উত্তরের জেলা রংপুরেও এই দিনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় অগ্নিশিখায়। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এতে ছয়জন নিহত হয়। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বাস্তবায়নে ফুঁসে উঠে ছাত্র-জনতা। বুলেটের জবাব দিতে একাট্টা গোটা দেশ। বিক্ষোভ দমাতে তখন মরিয়া স্বৈরাচারও। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে, আইশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীল ক্যাডারদের সর্বোচ্চ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সবমিলিয়ে বিভিষীকার শহরে পরিণত হয় রংপুর। এদিন রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়। রংপুরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় টিকে থাকা দায়। সড়কগুলো দেখলে মনে হবে যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ। রংপুর জিলা স্কুল মোড়, সিটি পার্ক মার্কেট চত্বর, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, বিএনপির কার্যালয় সংলগ্ন গ্র্যান্ড হোটল মোড়, শাপলা চত্বর, পুরাতন ট্রাক স্ট্যান্ড, কলেজ রোড চারতলার মোড়, লালবাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পার্ক মোড়, মডার্ন মোড়, দর্শনা মোড়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা ও ধাপ চেকপোস্ট এলাকা—প্রতিটি পয়েন্টেই একই চিত্র। রাজপথ থেকে আন্দোলনকারীদের হটাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। নির্বিচারে চালানো হয় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল। যেন এক যুদ্ধপরিস্থিতি। আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা আর গুজবের নগরীতে পরিণত হয় রংপুর।
শান্ত রংপুর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে
রংপুর নগরীতে শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল থেকেই ছিল না কোনো উত্তাপ। ওইদিন সরকারি ছুটি থাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে সুনশান ছিল পুরো নগর। আগের দিনের (বৃহস্পতিবার) তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নজর কাড়ে সাধারণ মানুষের। এরই মধ্যে শুক্রবার জুমার নামাজের পর শান্ত রংপুর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জিলা স্কুল মোড়, সিটি পার্ক মার্কেট চত্বর, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, বিএনপির কার্যালয় সংলগ্ন গ্র্যান্ড হোটল মোড়, শাপলা চত্বর, পুরাতন ট্রাক স্ট্যান্ড, কলেজ রোড চারতলার মোড়, লালবাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়, মডার্ন মোড়, দর্শনা মোড়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা ও ধাপ চেকপোস্ট এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়। কোথাও কোথাও পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়।
এপিসি থেকে গুলি চালায় এসপি শাহজাহান
ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলন চলাকালে গতবছরের ১৬ জুলাই আবু সাঈদ মারা যাওয়ার পর রংপুর হয়ে ওঠে সারা দেশের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত আবু সাঈদকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সারা দেশের মানুষকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেছিল। তবে, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের পরদিন পুলিশের কিছু সদস্যকে আরও বেপরোয়া আচরণ করতে দেখা যায় রংপুরে।
১৯ জুলাই আন্দোলন দমাতে সাঁজোয়া এপিসি যানে করে সিটি বাজারের সামনে আন্দোলনকারীদের দিকে তৎকালীন রংপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান গুলি ছোঁড়েন। সেদিন মূলত রংপুর সিটি বাজার এলাকা ছিল আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের সাথে রংপুর জেলা পুলিশের পোশাক পরিহিত সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এক সময় নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সাঁজোয়া এপিসি যানে করে সিটি বাজারের সামনে সিটি কর্পোরেশনের পাশে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ করেন তৎকালীন রংপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান।
পুলিশের গুলিতে নিহত ছয়
কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ায় পুরো রংপুর মহানগরী অগ্নিগর্ভে রূপ ধারণ করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র জনতাও যোগ দেয়। বিক্ষোভে উত্তাল ছিল রংপুর। ১৯ জুলাই বেলা ১২টার দিকে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ছাত্র জনতার বিশাল বিক্ষোভ মিছিল রংপুর সিটি বাজারের কাছে আসলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা বড় বড় ব্যাকি, রামদা, ছুরি ও পিস্তল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায়।
এক ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলাকালে আন্দোলনকারী হাজার হাজার ছাত্র জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটে। এ সময় পুলিশ তাদের রক্ষা করতে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে কলা ব্যবসায়ী মেরাজুল, শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির, ব্যবসায়ী সাজ্জাদ, স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী মোসলেম উদ্দিন, অটোচালক মানিক ও যুবক মাহমুদুল হাসান মুন্নাসহ ছয়জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় অর্ধশতাধিক ছাত্র জনতা।