ঢাকা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটেনি বিএনপির। চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে ইসলামপন্থীদের ‘একেক সময় একেক রকম বক্তব্য’ বিএনপিকে দুঃচিন্তায় ফেলে দিয়েছে। লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা নিয়েও দলটির নেতারা এখন সন্দিহান।
গত ১৩ জুন অর্ন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে জানানো হয়।
এর পর থেকে বিএনপি নেতারা তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে বলতে থাকেন, ‘লন্ডন বৈঠকের মধ্য দিয়ে স্বস্তি ফিরেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং দেশের মানুষের মাঝে। পাল্টে গেছে দৃশ্যপটও। ষড়যন্ত্রকারীরা হতাশ হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্র থেমে গেছে।’
জুনের শেষ সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘লন্ডনে বৈঠকের পর জাতি অত্যন্ত আনন্দিত। সবার মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। রমজানের আগে নির্বাচনের ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐক্যমত আছে। এ জায়গাতে দ্বি-মত আছে বলে মনে করি না। এখানে সবাই ঐক্যমত। এই জায়গাটার মধ্যে কোনো অসুবিধা আমি দেখছি না।’
কিন্তু বিএনপি নেতাদের এই উচ্ছ্বাস থেমে যায় ১২ জুলাই মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রদল-যুবদল নেতাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে এনে জামায়াত-এনসিপি-ইসলামী আন্দোলন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ‘লাগামহীন’ প্রপাগাণ্ডা শুরু করলে পুরো বিষয়টিকে নির্বাচন পেছানোর অজুহাত হিসেবে দেখে বিএনপি।
হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার একদিন পর গত ১৪ জুলাই দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার হচ্ছে কিনা এবং এর মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশকে বিঘ্নিত করার জন্য বিশেষ কোনো মহলের প্ররোচনায় এই ধরনের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।’
মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএনপিবিরোধী প্রচারণার মধ্যেই ১৬ জুলাই এনসিপির গোপালগঞ্জ সফরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা ও প্রাণহানির বিষয়টিও বিএনপিকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের ধারণা, নির্বাচন পিছিয়ে দিতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে বিঘ্নিত করার জন্য এবং আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিশ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ব্যাহত করবার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। মবোক্রেসি, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি অযোগ্যতা এবং নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাবৃন্দ গণমাধ্যমে শুধুই কথাই বলছেন, কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।’
এদিকে শনিবার (১৯ জুলাই) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে সংঘটিত কিছু নৃশংস ঘটনা জনমনে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারের কোনো একটি অংশের সহযোগিতায় কেউ কেউ দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কি না?— এ বিষয়টিও জনমনে জিজ্ঞাসা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব কি না? কোনো কোনো মহল থকে এমন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন বিচ্ছিন্ন বক্তব্য হিসেবে বোধহয় দেখার আর কোনো সুযোগ নেই।’
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির হাইকমান্ড থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন। তাদের বিশ্বাস, নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতারোহন নিশ্চিত। বাকি রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিরোধীদল হওয়ার মতো আসনও পাবে না। সে কারণেই নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি নানা ম্যাকানিজম করছে। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার আছে, ততদিন জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপির দাপট আছে। অন্তর্বর্তী সরকার চলে গেলে এসব দলের গুরুত্ব রাজনীতিতে আর থাকবে না।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রেখে একটি গোষ্ঠী আখের গুছিয়ে নিচ্ছে- এটা আমরা যেমন বুঝি, সাধারণ জনগণও তেমন বোঝে। সরকার যদি দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরে যায়, তাহলে এই গোষ্ঠীটার গুরুত্ব কমে যাবে। সে কারণে নানাভাবে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে তারা। এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের শঙ্কাটাই বিএনপির শঙ্কা।’