Monday 21 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২১ জুলাই ২০২৫ ০৮:০২ | আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৫ ১১:৫৩

জুলাইয়ের দিনলিপি। ২১ জুলাই ২০২৪। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ২১ জুলাই ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ দিন। সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রক্তাক্ত সংঘর্ষে রূপ নেয় এদিন। যদিও এদিন দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় বাতিল করে কোটা-সংস্কারের পক্ষে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেয় আপিল বিভাগ।

সেদিন সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারি চাকরিতে ৭% কোটার বাইরে বাকি ৯৩% পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে তা সাধারণ তালিকা থেকে পূরণের নির্দেশও দেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

কারফিউ-সংঘর্ষ: দেশের ৬ জেলায় ১৯ নিহত

চতুর্থ দিনের মতো কারফিউ ও ইন্টারনেট শাটডাউনের দিন ছিল ২১ জুলাই। নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘দেখামাত্র গুলি করার’ মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয় বলে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ তোলে। এদিন সকাল থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুপুরের দিকে ঢাকার মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল ও বাড্ডায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষে রক্তপাত শুরু হয়। প্রথমে গুলির খবর আসে পূর্বাচল থেকে, যেখানে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর পরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, নরসিংদীতে চারজন, গাজীপুরে দু’জন এবং নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও চট্টগ্রাম থেকে একজন করে আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর আসে।

শিল্পকারখানা বন্ধ, রাজপথে পোড়া বাস

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ২১ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও দেশের পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন কারখানা আগেই বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই বন্ধের সুযোগে রাজপথে ঘটে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা। সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বাড্ডা ও রামপুরায় কয়েকটি ভবন ভাঙচুর ও বিটিভি কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার খবর ছড়ায় মিডিয়ায়। আন্দোলনের সূত্র ধরে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের গাজীপুরের বাসভবনেও দু’দফা হামলা চালানো হয়।

আদালতের রায়

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেন— কোটার প্রয়োজন থাকলেও তা সীমিত ও যৌক্তিক হওয়া উচিত। নতুন ব্যবস্থায় ৫% মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ১% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১% প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সংরক্ষণ থাকবে। বাকি ৯৩% থাকবে পুরোপুরি মেধাভিত্তিক। তবে আদালত এ-ও বলে, ‘সরকার চাইলে সার্বিক বিবেচনায় কোটা বাতিল, সংশোধন বা পুনর্বিন্যাস করতে পারবে।’ অর্থাৎ, আইনি সীমারেখা নির্ধারণ করলেও সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ক্ষমতা সরকারের হাতেই।

রায়কে স্বাগত জানালেও শর্ত বেঁধে দেয় আন্দোলনকারীরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী সারজিস আলম আদালতের রায়কে সুবিচারের সূচনা হিসেবে স্বাগত জানান। তবে তিনি বলেন— ‘েচূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে নির্বাহী বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে।’

এর পর আন্দোলনকারীরা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে চার দফা দাবি তোলেন—

১. কারফিউ প্রত্যাহার
২. ইন্টারনেট সংযোগ পুনর্বহাল
৩. বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খোলা
৪. আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত

সেইসঙ্গে সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে ২২ জুলাই ‘গায়েবানা জানাজা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তারা।

নাহিদ ইসলামের সন্ধান

এদিন ভোরে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় আন্দোলের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায় এবং পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে শুক্রবার (১৯ জুলাই) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে নাহিদ ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

আন্দোলনকালীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘২২ জুলাই (সোমবার) কারফিউ বলবৎ থাকবে। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে।’ চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আন্দোলনকালীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সরকারের কড়া বার্তা ও গ্রেফতার

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল। ২১ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ৫৫০ জনের বেশি গ্রেফতার হন, যাদের মধ্যে অনেকেই বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী বলে উল্লেখ করা হয়। ঢাকায় গ্রেফতার ২০০ জনের মধ্যে ছিলেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায় এবং গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর। তাদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস’, ‘অগ্নিসংযোগ’ এবং ‘উসকানি’র অভিযোগে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ কামনা শেখ হাসিনার

২১ জুলাই রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে সামরিক-বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। এতে সেনাপ্রধান, তিন বাহিনীর প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এবং কারফিউ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

একটি রায়, একাধিক বাস্তবতা

কোটা ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আবেগ-সংবেদনশীল ইস্যু। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতির ওপর আদালতের রায়, তাতে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া এবং সরকারের কঠোর নিরাপত্তানীতি— সব মিলিয়ে ২১ জুলাই হয়ে ওঠে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের আরেকটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

২১ জুলাই ২০২৪ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব জুলাইয়ের দিনলিপি রায় বাতিল হাইকোর্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর