ঢাকা: ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি টালমাটাল দিন। কোথাও স্বস্তির নিঃশ্বাস, কোথাও অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। ঢাকার আকাশ থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের গলিপথ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা। এই একদিনেই যেন আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ও প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে রক্তাক্ত ইতিহাস হয়ে ওঠে।
প্রজ্ঞাপন: প্রত্যাশার প্রতিফলন
এই দিনেই সরকার কোটা সংস্কার নিয়ে বহু প্রতীক্ষিত সিদ্ধান্ত আসে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ৯৩% মেধা ও ৭% সংরক্ষণের ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নতুন নিয়ম প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। দীর্ঘ আন্দোলনের একটি ‘বিজয়সূচক’ মুহূর্ত হিসেবে অনেকে দেখলেও, প্রজ্ঞাপন জারির সময়-পরিপ্রেক্ষিত তার গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধও করে।
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ৯ম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন করপোরেশনে। অর্থাৎ, দেশের চাকরি বাজারে একটি বড়সড় পুনর্বিন্যাসের শুরু।
কারফিউর শিথিল, সীমিত ইন্টারনেট ও খোলা মহাসড়ক
ষষ্ঠ দিনের মতো সারাদেশ ছিল ইন্টারনেটবিহীন এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জরুরি সেবা ও মিডিয়ার জন্য রাতে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড চালু হয়। জনজীবনের কাছে এ যেন মরুভূমিতে কয়েক ফোঁটা জল!
কারফিউও কিছুটা শিথিল হয়। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু করে। যদিও জনসাধারণ তখনও ছিল আতঙ্কিত। সরকার একইদিন ঘোষণা দেয়, পরদিন অফিস ও গার্মেন্ট কারখানা আংশিকভাবে চালু থাকবে।
চিরুনি অভিযানে গ্রেফতার ১১০০ জন, ঢাকায়-ই ৫১৭
রাজপথ তখনো রক্তাক্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘চিরুনি অভিযান’ অব্যাহত থাকে। একদিনেই ১ হাজার ১০০ জনকে গ্রেফতার হয়। যার মধ্যে ঢাকাতেই ছিল ৫১৭ জন। ১৭ থেকে ২৩ জুলাই— এই এক সপ্তাহে সারা দেশে গ্রেফতার ছাড়িয়ে যায় তিন হাজার। মঙ্গলবারেই হয় আরও ৩৮টি মামলা। নাম-পরিচয়হীন ‘ছাত্র’ শব্দটি তখন অনেকের জন্য ভয়, আবার অনেকের জন্য অহংকার।
শিক্ষার্থীদের ৪ দফা ও ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম
ফিরে আসে রাজপথের সাহস। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ চার দফা দাবি তোলে—
- ইন্টারনেট চালু করতে হবে
- কারফিউ প্রত্যাহার
- আবাসিক হল খুলে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ফেরার পরিবেশ তৈরি
- আন্দোলনের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত
দাবি পূরণ না হলে কঠোর কর্মসূচির আলটিমেটাম। ৪৮ ঘণ্টার সময় দেওয়া হয় সরকারকে। এদিন ছাত্রনেতা সারজিস আলম বলেন, ‘সরকার চাইলে সংলাপের পথ খুলবে। আমরা প্রস্তুত।’
নিখোঁজ ছাত্রনেতা, উদ্বেগের ছায়া
১৮ জুলাই থেকে নিখোঁজ তিন ছাত্রনেতা— আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদ। তাদের সন্ধানে ছাত্রসমাজ ব্যাকুল। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। তখনো কেউ জানে না, তারা বেঁচে আছেন কি না।
সরকারের নরম কথার আড়ালে কঠোর হুঁশিয়ারি
এদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশ্বাস দেন, ‘যদি নিরীহ শিক্ষার্থীর নামে মামলা হয়, খতিয়ে দেখা হবে।’ কিন্তু র্যাবের তৎকালীন ডিজি মো. হারুন অর রশিদের ভাষ্য একেবারেই আলাদা— ‘ছাত্র আন্দোলনের নামে যারা নাশকতা চালিয়েছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আবাসিক হল খুলতে হলে আগে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ কিন্তু নিরাপত্তাহীনতায় নিখোঁজ ছাত্রনেতারা তখনও ফেরেননি।