চট্টগ্রাম ব্যুরো: নিতান্ত দিন এনে দিন খাওয়া গরিব পরিবারের মেধাবী সন্তান হৃদয় তরুয়া। পেটে ভাত জোগাতেই বাবা-মায়ের হিমশিম অবস্থা, সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোগাবেন কীভাবে! তাই এইচএসসি’র গণ্ডি পেরোতেই মেয়েকে বিয়ে দিলেন। কিন্তু একমাত্র ছেলে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল, পেটে ‘কাপড় বেঁধে’ সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে থাকেন বাবা-মা। আশা ছিল ছেলে পড়ালেখা শিখে সংসারের হাল ফেরাবে।
হৃদয়েরও স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে ভালো চাকরি করবে, মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। তাই তো দেশজুড়ে যখন সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল হৃদয়। কিন্তু একটি বুলেট ২২ বছরের টগবগে যুবক হৃদয়ের সব স্বপ্ন শেষ করে দেয়। আশার প্রদীপ নিভিয়ে দেয় তার বাবা-মায়ের।
বৈষম্যবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। আন্দোলন হৃদয় তরুয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ছয়দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৩ জুলাই ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার মানে।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা রতন তরুয়া আর মা অর্চণা রাণী তরুয়ার সেই যে কান্না শুরু হয়েছে, একবছরেও সেটা আর থামেনি। শোক আর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন তার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরাও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন হৃদয় তরুয়া। জন্ম পটুয়াখালী উপজেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটক আন্দুয়া গ্রামে। বাবা রতন তরুয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি আর মা অর্চণা রাণী গৃহপরিচারিকার কাজ করেন।
হৃদয়ের বাবা রতন তরুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী ছিল। সে এসএসসি-এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল। আমি গরিব মানুষ। ভালো করে মাস্টারও রাখতে পারিনি। নিজের চেষ্টায় সে এতদূর এসেছিল। টিউশনি করে পড়ালেখা করতো। পরে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল, আমি তো পড়াতে রাজি ছিলাম না, আমার তো অত সামর্থ্য নেই। তার মা বলল, আমি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করব, তবুও ছেলেকে পড়াব।’
‘আমার ছেলে বলেছিল, বাবা কয়েকটা বছর কষ্ট কর, আমি পাস করে বের হয়ে বিসিএস পরীক্ষা দেব। আমার ভালো চাকরি হবে। তখন আর কোনো কষ্ট থাকবে না। ঈশ্বর আমাদের স্বপ্নটা আর পূরণ করলেন না। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল,’– একথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ক্লাসের সহপাঠী, হলের রুমমেট- কেউই এখনো মানতে পারছেন না হৃদয় আর নেই! সবুজ পাহাড়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরতে পরতে যেন হৃদয়ের স্মৃতি। শূন্যতার হাহাকার সবার মধ্যে। তাই-তো হৃদয় কখনো ক্যাম্পাসে ফেরেন গ্রাফিতি হয়ে কিংবা সহপাঠীদের চোখের জলে ছবি হয়ে।
দিনভর ক্লাস শেষে দুপুরেই টিউশনি করতে চলে যেত শহরে। হলে ফিরতে রাত ১০টা পেরিয়ে যেত। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত পড়ালেখা করতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে নিজের খরচ নিজেই চালাতো। এভাবেই সংগ্রাম করে স্বপ্নের পথে একটি-একটি দিন পার করছিল হৃদয়।
হৃদয়ের সহপাঠী ইতিহাস বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সাব্বির আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হৃদয় তরুয়া আমার রুমমেট ছিল। তার জীবনসংগ্রাম আমি নিজের চোখে দেখেছি। আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকে আমরা প্রতিদিন একসঙ্গে যেতাম। শুরু থেকেই আমরা অনেক অ্যাক্টিভ ছিলাম। বহদ্দারহাটে যখন গোলাগুলি হচ্ছিল, সেখানে এভাবে তাকে এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হবে, এটা কল্পনায়ও ছিল না। তার সঙ্গে আমার এত স্মৃতি! একসঙ্গে ক্লাস শেষ করে শাটল ট্রেনে করে টিউশনি করতে শহরে যেতাম। প্রিয় বন্ধুকে খুব মিস করি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীমা হায়দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হৃদয় তরুয়া যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আমি ভুলতে পারছি না। সন্তান হারানোর মতো ব্যাথা অনুভব করি।’
রতন তরুয়া জানালেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতারাও গিয়েছিলেন। সবাই বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তার মেয়ে মিতুকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বিভাগে একটি চাকরি দিয়েছে। সরকারি সাহায্যের টাকাও পেয়েছেন।
মৃত্যুর আগে সন্তান হত্যার বিচার দেখে যেতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। মৃত্যুর পর আমার মুখে আগুন দেওয়ার কথা ছিল তার। অথচ তার মুখে আমাকে আগুন দিতে হয়েছে। এই কষ্ট আমি বলে বোঝাতে পারব না। যারা আমাকে সন্তানহারা করেছে, আমার হৃদয়ের মতো আর শত, শত ছেলেমেয়ের প্রাণ যারা কেড়ে নিয়েছে, আমি তাদের কঠিন শাস্তি চাই। তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব।’