ঢাকা: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি হলফনামার খসড়া প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জানা গেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে কমিশন এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়। হলফনামার খসড়ায় এবার দেশি-বিদেশি সম্পদের হিসাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রার্থীদের হলফনামায় ম্যাজিস্ট্রেট বা নোটারি পাবলিকের সই এবং সিলও থাকতে হবে। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানান নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
জানা গেছে, খসড়ায় দ্বৈত নাগরিকত্ব, তফসিলের আগ পর্যন্ত কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে থাকলে, প্রার্থীর নির্ভরশীলদের পেশা, দেশের সম্পদের বাইরে বিদেশে থাকা সম্পদবিবরণী, প্রতিনিধিত্বের ইতিহাস, আয়করের যাবতীয় তথ্য এবং হলনাফায় মিথ্যা তথ্য দেননি সেই অঙ্গীকারসহ নানান বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া, ই-মেইলে মনোনয়নপত্র জমারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে প্রস্তাবনায়।
হলফনামার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রার্থীর নির্বাচনি এলাকার নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি অনুযায়ী) নাম, মাতা-পিতা, স্বামী-স্ত্রী, বর্তমান-স্থায়ী ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ঘরে (হ্যাঁ-না), নাগরিকত্ব দেশের নাম ও ত্যাগকারী দেশের নাম উল্লেখ করতে হবে। প্রার্থীকে ঘোষণা করতে হবে যে, সংবিধানের ৬৬(২) এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা-১২-এ তিনি অযোগ্য নন।
এদিকে, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জামিনে মুক্তদের জামিন লাভের সত্যায়িত কপি ও জেল কর্তৃপক্ষের সত্যায়িত কপি যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেইসঙ্গে মামলার বিস্তারিত যেমন- কোন আইন ও ধারায় মামলা হয়েছে, যে আদালতে মামলাটি দায়ের হয়েছে, মামলার নম্বর এবং মামলার সর্বশেষ অবস্থা দিতে হবে। এ ছাড়া, যেসব ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন সেগুলোসহ মামলা নিষ্পত্তির বছর উল্লেখ করতে হবে।
পেশার ক্ষেত্রে বর্তমান ও আগের পেশা এবং স্বামী-স্ত্রীর বর্তমান ও আগের পেশা লিখতে হবে। এ ছাড়া, নির্ভরশীলদের পেশার বিস্তারিত বিবরণ দিতে হবে। আয়ের উৎস উল্লেখ করতে হবে প্রার্থীকে। এর মধ্যে যেমন, কৃষিখাত, বাড়ি-ফ্ল্যাট-বাণিজিক স্থান, স্থাবর সম্পত্তি, ব্যবসা, শেয়ার বন্ড, বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে দেশের ভেতর-বাইরে এবং নির্ভরশীলদের দেশের ভেতর-বাইরে সম্পদের বিবরণ পেশ করতে হবে।
এ ছাড়াও, প্রতিনিধিত্বের ইতিহাসে নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি ও অর্জন উল্লেখ করতে হবে। ঋণসংক্রান্ত বিবরণীতে পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান বা তার ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি ঋণ নিলে সেটাও উল্লেখ থাকতে হবে। ঋণ থাকলে ব্যাংকের নাম, ঋণের পরিমাণ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও পুনঃতফসিল করা হলে সর্বশেষ তথ্য হলফে বলতে হবে। আয়কর বিবরণীতে নিজ ও পরিবারের, সর্বশেষ রিটার্ন দাখিল-টিআইএন, আয়কর রিটার্নে দেখানো আয়, সম্পদ ও আয়করের পরিমাণ নিজ, স্ত্রী-স্বামী-সন্তান ও নির্ভরশীলদের তথ্য উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়া, গত পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্ন উল্লেখ করতে হবে।
হলফনামা সংস্কারসংক্রান্ত বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি সম্পদের হিসাব বাধ্যতামূলক করে হলফনামার খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন নিঃসন্দেহে ইসির একটি ভালো উদ্যোগ। এর ফলে স্বচ্ছতা বাড়বে, রোধ হবে কালো টাকার খেলা। যা আমাদের সবারই প্রত্যাশা। নির্বাচনে স্বচ্ছতা থাকাটা খুব বেশি জরুরি।’ বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।
নির্বাচনি হলফনামা কী
বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থীদের একটি হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এই হলফনামায় প্রার্থীদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত ও আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে। সাধারণত মনোনয়নপত্র দাখিলের পর পরই সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিস থেকে এ গুলো সংগ্রহ করা যায়। সেখান থেকে ভোটাররা ভোট দেওয়ার আগেই প্রার্থী সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারেন।
২০০৮ সাল থেকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেওয়ার নিয়ম কার্যকর হয়। যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তার উপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে।
হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাই ও প্রার্থিতা
হলফনামায় প্রার্থীর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সবকিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে। এটা দেখার দায়িত্ব মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠানের। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনের; দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশনের এবং তৃতীয়ত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। প্রত্যেক প্রার্থীই আয়কর রিটার্ন জমা দেন। সেটার সঙ্গে হলফনামার মিল আছে কি না সেটা রাজস্ব বোর্ড দেখবে। কেউ দুর্নীতি করে টাকা উপার্জন করেছেন কি না সেটা দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন। আর অন্যান্য সব বিষয় দেখবে নির্বাচন কমিশন। কারণ, হলফনামায় ভুল তথ্য থাকলে এবং সেটি প্রমাণিত হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভুল তথ্য পেলে কমিশন চাইলে প্রার্থিতাই বাতিল করে দিতে পারে। তখন প্রার্থী হাইকোর্টে আবেদন করতে পারেন। হাইকোর্ট যদি তার আবেদন মঞ্জুর করেন, তাহলে ওই প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।