Friday 25 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
সাংবাদিকদের নিয়ে শেখ হাসিনার বৈঠক, চিরুনি অভিযানে গ্রেফতার ১৪০০

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৪ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৯ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৫ ২২:৪৩

জুলাইয়ের দিনলিপি। ২৪ জুলাই ২০২৪। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ২৪ জুলাই ২০২৪। একদিকে চিরুনি অভিযান, চোখবাঁধা প্রতিবাদী মুখ, বেওয়ারিশ মরদেহের কবর; অন্যদিকে ইন্টারনেটের ক্ষীণ আলোয় জনগণের ক্ষীণ আশার দীপ্তি। এ যেন একদিনে গাথা শত গল্পের রক্তাক্ত কোলাজ। এদিনই সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কারফিউ ও কারাগার

পাঁচ দিন পর সেদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় কারফিউ শিথিল করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘চিরুনি অভিযান’ অব্যাহত রাখে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় বের হয় নিত্য প্রয়োজনে। কারও মুখে আতঙ্ক, কারও চোখে নীরব ক্ষোভ। পঞ্চম দিনের মতো রাস্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব। প্রতিটি গাড়ি, মানুষ, জিজ্ঞাসাবাদের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

শুধু ২৪ জুলাই সারাদেশে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, যার ৬৪১ জন-ই ঢাকায়। আটদিনে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার হাজার। সেই তালিকায় ছাত্র, বেকার, রাজনীতিক, দিনমজুর কে নেই! সূত্র বলছে, বেশিরভাগই বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী, আবার অনেকেই আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র।

ইন্টারনেটের ধীর গতিতে তথ্যের সন্ধান

এদিন রাত ১০টায় প্রথমবারের মতো সীমিতভাবে চালু হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। মোবাইল ইন্টারনেট তখনও বন্ধ। কিন্তু ফাইবারের হালকা লাইনে কিছু পোস্ট, কিছু কান্না, কিছু প্রতিবাদ ভেসে আসে। নিখোঁজদের খোঁজ মেলে ফেসবুকে। আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদ— তাদের পাওয়া যায় চোখ বাঁধা অবস্থায় পরিত্যক্ত একটি জায়গায়। চোখের বাঁধন খুললেও মনের আতঙ্ক তখনও বাঁধা। আসিফ মাহমুদকে রাজধানীর হাতিরঝিল ও আবু বাকেরকে ধানমন্ডি এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। তাদের কে বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। রিফাত ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘গুম হতে হতে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম।’

বেওয়ারিশ মৃত্যুর মিছিল বাড়ে

আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আরও আরও চারজন মারা যান। এদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে তিনজন, এনাম মেডিকেলে একজন। সরকারি হিসেবে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সংখ্যা জানা যায় ২০১ জনের মৃত্যু। এমনকি আটজনের পরিচয় মেলেনি বলে ঢাকা মেডিকেলেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় তাদের। এই ‘অপরিচিত মৃতেরা’ কে ছিলেন? ছাত্র? শ্রমিক? পথচারী? কে জানে! তবে রাষ্ট্রের চোখে তারা এখন শুধুই সংখ্যা।

সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন তার কার্যালয়ে এডিটরস গিল্ড আয়োজিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক এবং হেড অব নিউজদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা (বিএনপি-জামায়াত) আমাদের নির্বাচন করতে দিতে চায়নি, কিন্তু আমরা নির্বাচন করেছি। আমার একটা আশঙ্কা ছিল যে, এরকম একটা আঘাত আসবে। শিক্ষার্থীদের এই কর্মকাণ্ড ও আন্দোলন একটি গুরুতর ষড়যন্ত্র।’

সেদিনের সেই বৈঠকে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা ছাত্র-আন্দোলন দমাতে সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়। বৈঠক উপস্থিত ছিলেন- মো. নাঈমুল ইসলাম খান, মোজাম্মেল হক বাবু, আবেদ খান, নঈম নিজাম, মনজুরুল ইসলাম, শ্যামল দত্ত, সাইফুল আলম, ফরিদা ইয়াসমিন, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, দীপ আজাদ, মাইনুল আলম, শাজাহান সরদার, জায়েদুল আহসান পিন্টু, আশীষ সৈকত, জুলফিকার রাসেল, শাকিল আহমেদ প্রমুখ।

রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা আর প্রতিক্রিয়া

সরকার চায় বিশ্বের সামনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে। বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখানো হয় ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন, স্বাস্থ্য অধিদফতর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন জানায়, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। প্যাট রাইডারের কণ্ঠে শোনা যায় যুক্তরাষ্ট্রের সেই চিরচেনা আহ্বান— ‘সবাই শান্ত থাকুন।’ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।’ অথচ মানুষ বলছে, নিয়ন্ত্রণ নয়, এটা নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে দেওয়ার মতো।

আশা ও আশঙ্কার দ্বৈরথ

এদিন ঢাকায় চালু হয় দূরপাল্লার বাস, নদীবন্দর থেকেও ছাড়ে লঞ্চ। কেউ ফিরছিল গ্রামে পলায়নের মতো, কেউ ফিরছিল শহরে লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে। সরকারি অফিস, ব্যাংকও খোলে সাময়িকভাবে। আবার কেউ কেউ কাঁদছিল নিখোঁজ প্রিয়জনের জন্য, যাদের জন্য কোনো কারফিউ, কোনো রাষ্ট্রীয় ঘোষণা ছিল না।

জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন সেমিস্টারের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেই পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। চলমান পরিস্থিতির কারণে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সব পরীক্ষাও স্থগিত করে। এতে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক বিভাগীয় পরীক্ষা (জুন-২০২৪), নন-ক্যাডারের স্ট্যান্ডার্ড অ্যাপটিচুড টেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা স্থগিত থাকে।

জীবন বনাম রাষ্ট্র: এক অসম লড়াই

একদিকে রাষ্ট্রের দাবির পক্ষে ‘চিরুনি অভিযান’, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের চার দফা দাবি—ইন্টারনেট চালু, কারফিউ প্রত্যাহার, গ্রেফতার বন্ধ, হত্যার বিচার। সমন্বয়কারীদের মধ্যে ভিন্নমত থেকেও ২৫ জুলাই দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচির ডাক আসে।

নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো দুই নারী ‘জঙ্গি’ ইশরাত জাহান মৌসুমি ওরফে মৌ ও খাদিজা পারভীন মেঘলাকে গ্রেফতার করে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট। এ ছাড়া, পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দিদের ২৯২ জন আত্মসমর্পণ করেন। এই সংখ্যাও বুঝিয়ে দেয় রাষ্ট্রের আস্থার ভিত কতটা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল।

২৪ জুলাই ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার এক পরীক্ষার দিন। কেউ প্রমাণ করল ক্ষমতার ভার, কেউ দেখাল নিঃশব্দ প্রতিবাদের শক্তি। কেউ হারাল সন্তান, কেউ হারাল স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

২৪ জুলাই ২০২৪ চিরুনি অভিযান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব জুলাইয়ের দিনলিপি বৈঠক শেখ হাসিনা সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর