ঢাকা: বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান পড়ে বিধ্বস্ত মাইলস্টোনের স্কুলের বাতাসে এখনো ভাসছে জেট ফুয়েল ও পোড়া ভবনের গন্ধ। এ ছাড়া, বিধ্বস্ত ও পোড়া স্কুল ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট্ট শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ ও বইখাতা। এমনকি, পড়ে আছে খাবারসহ টিফিনের বাটিও— মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধ্বংসস্তুপ হায়দার আলী ভবনে সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রীদের দিকবিদিক ছোটাছুটি ও আর্তনাদ। এমনকি পোড়া শরীর নিয়েও ছুটতে থাকে শিক্ষার্থীরা। অপেক্ষমাণ অবিভাবদের কেউ কেউ ঘরে ফেরেন বেঁচে যাওয়া সুস্থ সন্তান নিয়ে, কেউ আবার সন্তানের লাশ নিয়ে, কেউবা ছুটে যান হাসপাতালে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় অবিভাবক ছাড়াও সাধারণ মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে রাজধানীর বাতাস।
সরেজমিনে দেখা যায়, যুদ্ধবিমানের আঘাতে ভবনটি পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে ভবনের কয়েকটি ক্লাসরুম। ভবনটির নিচে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়েছে। ধ্বংস হওয়া ভবনে ছড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ, বইখাতা, শিক্ষার্থীদের হাজিরা ও মূল্যায়নখাতা। ধ্বংসস্তূপের পাশে পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের জুতো। বীভৎসভাবে ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে স্কুলটি। বিধ্বস্ত এই স্কুলটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে সাধারণ মানুষ।
ওইদিন স্কুলটিতে দুপুরে টিফিনের খাবার খেতে বসেছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তার আগেই বিমানের আঘাত। তাই সেই খাবারসহ বাটিও পড়ে আছে। কেউ পাশেই দোলনায় খেলছিল। কিন্তু, সেই দোলনা এখন কর্দমাক্ত। সেটি ফাঁকা পড়ে আছে। পায়েল, আজরিন করিম, লাবাবিবা তাসনিমদের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী আর খেলবে না স্কুলের দোলনাটিতে।
তানভীর ও তাশরীফ নামের দুই ভাই পড়ত এই স্কুলটিতে। ছোট ভাই তাশরীফের ছুটি হলে সে বাসায় চলে যায়। কিন্তু বড় ভাই তানভীরকে ফিরতে হয় লাশ হয়ে। এ বিষয়ে তাদের চাচাতো ভাই খাইরুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই ভাই সকালে একসঙ্গে স্কুলে এসেছিল। কিন্তু তানভীর আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেল। তানভীর চিকিৎসক হতে চেয়েছিল, সেই স্বপ্ন আগুনে পুড়ে গেল।’
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করত নয় বছর বয়সী সাময়া আক্তার। কিন্তু যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। সায়মার বাবা শাহ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমান বিধ্বস্তের কথা ফোন করে আমার বন্ধু জানালে আমরা ছুটে যাই স্কুলে। কিন্তু খোঁজাখুজির পর রাতে তাকে পাই সিএমএইচ-এ। তবে তখন সে আর বাবা বলে ডাকছে না। নিথর দেহটি পড়েছিল আমার মেয়ের। প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতাম। বাবার হাত ধরে সে আর স্কুলে যাবে না।’
সেদিন বিমানের আঘাতটি চাক্ষুস করেছেন প্রতিষ্ঠানটির অষ্টম শ্রেণির রিফাত ও এসএসসি পরীক্ষার্থী রাতুল। তারা সারাবাংলাকে বলেন, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দে ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। একেকজনের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়েছিল। শিক্ষার্থীরা পুড়ে ছাই হয়ে যায় চোখের সামনে। কিন্তু কিছু করার ছিল না।
এদিকে, মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তে শতাধিক শিক্ষার্থী মারা যায় বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কলেজের শিক্ষার্থীদের। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী বুলবুলসহ আরও কয়েকজন সারাবাংলাকে বলেন, নিহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছিল। তাহলে এই কয়জন কিভাবে মারা যায়? অনেকের শরীর পুরে ছাই হয়ে গেছে। আমরা মনে করছি, সঠিক সংখাটি লুকানো হচ্ছে।
মৃত্যুর সংখ্যা অভিযোগের বিষয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডিরেক্টর কাজী বিলকিস আরা আইরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমান দুর্ঘটনায় বাচ্চারা মারা গেছে এটি আমি মেনে নিতে পারছি না। ছোট ছোট সব ছেলেমেয়ে। বয়সই বা কত হয়েছিল। জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের প্রাণ কেড়ে নিল। আর মৃত্যুর সংখ্যা বেশি- এ রকম যে অভিযোগ সঠিক নয়। এই সংখ্যা তো গোপন করার কিছু নাই। শিক্ষার্থীদের তো উপস্থিতির খাতা আছে। সেগুলো আমরা লুকাবো কীভাবে। যদি কেউ এখন পর্যন্ত সন্তানকে খুঁজে না পেতেন তাহলে তো আমাদের কাছে ছুটে আসতেন। আমরা তো সেরকম কিছু দেখছি না।’
অপরদিকে, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জায়গার অনুমোদন নিয়ে। এমনকি এখানে নিমির্ত কলেজটি বিমান রানওয়েতে নামার ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আশেপাশে উঁচু উঁচু ভবন থাকায় মূলত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান নামার জন্য মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের মাঠটি বিমানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই রানওয়েতে বিমান নামতে হঠাৎ ত্রুটি দেখা দিলে আবারও যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত মাইলস্টোনসহ আশপাশের ভবনগুলো এর দায় এড়াতে পারে না।