চব্বিশের জুলাইয়ে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ এবং ‘যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই গুলি’ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আল জাজিরার হাতে আসা তার গোপন ফোন কল রেকর্ডিংগুলো থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হয়েছে। এতে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এবং তার বিচার প্রক্রিয়া নতুন মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) আল-জাজিরায় এ সম্পর্কিত এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য এখানে তার ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো।
১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ শাসন করা শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তার পদত্যাগের আগে কয়েক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভ এবং সরকারি বাহিনীর নৃশংস দমন-পীড়নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)-এর তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি আহত হয়েছিলেন।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) এসব রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করতে অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে, রেকর্ডিংগুলোতে কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারসাজি হয়নি এবং ভয়েস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে কলকারীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (এনটিএমসি) গত বছরের ১৮ জুলাই একটি কল রেকর্ড করেন। যেখানে শেখ হাসিনা তার একজন সহযোগীকে জানান, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশানা ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। আমি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ্যে নির্দেশ জারি করেছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে। এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি এতক্ষণ তাদের থামিয়ে রেখেছিলাম… আমি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলাম।’
পরে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র এবং শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আরেক কলে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহারের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে তারা কোনো সমাবেশ দেখবে, তা ওপর থেকে – এখন ওপর থেকে করা হচ্ছে – ইতিমধ্যেই কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়েছে। এটি শুরু হয়ে গেছে। কিছু বিক্ষোভকারী সরে গেছে।’
ওই সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী আকাশ থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। কিন্তু, ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শাব্বির শরীফ আই-ইউনিটকে বলেন, ‘একটি হেলিকপ্টার থেকে আমাদের হাসপাতালের গেট লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অস্বাভাবিক গুলির আঘাতে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা করেছিলাম। গুলি হয় কাঁধে বা বুকে ঢুকেছে। গুলিগুলো সবই শরীরের ভেতরে থেকে গেছে। যখন আমরা এক্স-রে করে দেখলাম, তখন আমরা হতবাক হয়েছিলাম। কারণ, সেখানে অনেক গুলি ছিল।’ তবে আল জাজিরা কী ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল তা যাচাই করতে পারেনি।
এই ফাঁস হওয়া কলগুলো প্রসিকিউটররা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আসিটি) প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। আইসিটি ইতিমধ্যেই শেখ হাসিনা, সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা ও তার সহযোগী দুই কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আগস্টে বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এই ফোনালাপগুলো রেকর্ড করেছে শেখ হাসিনার নিজস্ব নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি। এনটিএমসি-এর বিরুদ্ধে শুধু বিরোধী দলের ব্যক্তিরাই নয়, এমনকি হাসিনার রাজনৈতিক সহযোগীরাও নজরদারির অভিযোগ করেছিল।
আইসিটি’র প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতেন তাকে রেকর্ড করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে, অন্যরা তাকে বলত, আমাদের… ‘টেলিফোনে এই বিষয়ে আলোচনা করা উচিত নয়’। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি, এটি রেকর্ড করা হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।’’
তিনি আরও বলেন, ‘তিনি অন্যদের জন্য একটি গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন তিনি নিজেই গর্তে।’
এদিকে ২০২৪ সালের জুনে উচ্চ আদালত ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনরায় চালু করার পর শান্তিপূর্ণভাবে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেছিল, এই পদ্ধতিটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সমর্থকদের পক্ষপাতিত্ব করে এবং সরকারি চাকরির অনেক পদ যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয় না।
গত ১৬ জুলাই, রংপুরে পুলিশি গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন। তার এই মৃত্যু জুলাই মাসের গণআন্দোলনের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যা দেশব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং বিক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে।
শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি গোপন ফোন রেকর্ডিংয়ে তাকে সাঈদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করতে শোনা গেছে। ওই কলে, সালমান এফ রহমান পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে শুনা যায়। তিনি জানতে চান, ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেতে এত সময় লাগছে কেন? কে লুকোচুরি খেলছে? রংপুর মেডিকেল?’ তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কথা উল্লেখ করছিলেন; যেখানে সাঈদের ময়নাতদন্ত করা হচ্ছিল।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার রাজিবুল ইসলাম আল জাজিরাকে বলেন, ‘একাধিক গুলির আঘাতের কোনো উল্লেখ যাতে না থাকে সেজন্য পুলিশ আমাকে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাঁচবার পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল। তারা এমন একটি রিপোর্ট লিখতে চেয়েছিল যাতে বলা হয়, আবু সাঈদ ভাই পাথর নিক্ষেপের আঘাতের কারণে মারা গেছেন, যদিও তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।’
আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ১২ দিন পর, তার পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। মোট ৪০টি পরিবারকে সেখানে জড়ো করা হয়েছিল– যাদের সবার আত্মীয়-স্বজন বিক্ষোভে নিহত হয়েছিল।
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের গণভবনে আসতে বাধ্য করেছিল। তারা আমাদের আসতে বাধ্য করেছে। না আসলে তারা হয়তো আমাদের অন্যভাবে নির্যাতন করত।’
ওই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে প্রতিটি পরিবারের হাতে টাকা তুলে দিতে দেখা যায়। সাবেক প্রথানমন্ত্রী আবু সাঈদের বোন সুমি খাতুনকে বলেন, ‘আমরা আপনার পরিবারের জন্য বিচার নিশ্চিত করব। উত্তরে আবু সাঈদের বোন বলেন, ‘ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, পুলিশ তাকে গুলি করেছিল। এখানে তদন্ত করার কী আছে? এখানে আসা ভুল ছিল।’
আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনই প্রাণঘাতী অস্ত্র শব্দটি ব্যবহার করেননি। এমন কি তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্টভাবে অনুমোদন দেননি। এই রেকর্ডিংগুলো হয় আংশিকভাবে, না হয় কারসাজি করা হয়েছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আবু সাঈদের মৃত্যু তদন্তের জন্য সরকার আন্তরিকতা দেখিয়েছে।’