গত মাসে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের ১২ দিনের সংঘাতকে ইসরায়েলি নেতৃত্ব একটি বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখছে। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক নেতা নিহত হয়েছেন, দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিকে ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি যৌথ অভিযানে অংশ নিতে রাজি করানো গেছে। তবে, এই ‘বিজয়’ উদযাপনের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর শঙ্কা। ইসরায়েল কি আবারও ইরানের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি ‘গতি কমানোর কোনো ইচ্ছা রাখেন না’ এবং প্রয়োজনে ফের হামলা চালাতে প্রস্তুত। আল জাজিরার বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এখন ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করার জন্য আরেকটি সংঘাতের সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বড় পদক্ষেপের জন্য অপরিহার্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনুমতি’ কি এবারও মিলবে? সাম্প্রতিক এই সংঘাত এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে ইসরায়েল যেমন তার গোপন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি ইরানও যেকোনো হামলার জন্য প্রস্তুত। এই টানাপোড়েন কি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বাজাবে?
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) আল-জাজিরায় এ সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনের ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো।
গত জুনের মাঝামাঝি ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা এই যুদ্ধের জন্ম দেয়। যেখানে এক হাজার জনেরও বেশি ইরানি এবং ২৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন। ইসরায়েল দাবি করে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে ‘আত্মরক্ষামূলক’ হামলা চালিয়েছে। যদিও তেহরান দীর্ঘদিন ধরেই বলছে তাদের কর্মসূচি বেসামরিক উদ্দেশ্যে।
সম্প্রতি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বর্তমান যুদ্ধবিরতি কতদিন টিকবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের যেকোনো নতুন সামরিক পদক্ষেপের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের গভীরে ফের আঘাত হানতে প্রস্তুত।’
ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করার কথা বললেও, তারা মূলত উচ্চপদস্থ সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, ইসরায়েল ইরানি শাসনকে দুর্বল করতে এবং সম্ভবত উৎখাত করতে চাইছে।
ইরান বিশেষজ্ঞ ত্রিটা পারসি বলেন, ‘নেতানিয়াহু এই অভিযান পুনরায় শুরু করার সুযোগ খুঁজছেন। ইসরায়েলিরা ফের হামলা চালাতে চায়… কারণ তারা ইরানকে পরবর্তী সিরিয়া বা লেবাননে পরিণত করতে চায় – এমন দেশ যেখানে ইসরায়েল যেকোনো সময় বিনা বাধায় হামলা চালাতে পারবে।’
ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের ওপর আবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ইসরায়েল সম্ভবত যুদ্ধের নতুন অজুহাত খুঁজে নেবে। জুলাইয়ের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা একমত হয়েছেন, আগস্টের মধ্যে নতুন পারমাণবিক চুক্তি না হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় আরোপ করা হবে।
২০১৫ সালে একটি পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতির অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞাগুলো ফের চালু করে। এখন ইউরোপীয় দেশগুলোও একই পথে হাঁটতে পারে, যা ইরানকে পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে প্ররোচিত করতে পারে- এমনটাই সতর্ক করেছেন পারসি। তার মতে, ‘এটি ইসরায়েলকে ফের হামলা চালানোর একটি রাজনৈতিক সুযোগ দেবে।’
তবে, ইসরায়েলের রিকম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান লেকচারার মেয়ার জাভেদনফার বলেন, ‘হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে এমন বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য প্রমাণ করতে হবে, যেখানে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনর্গঠন বা মেরামত করছে। এমন হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমতি নিতে হবে। তবে সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের ফলে বুঝা যাচ্ছে সেটা ইসরায়েলের জন্য কঠিন হবে।’
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও ইরানে ইসরায়েলি হামলা এখনই আসন্ন মনে হচ্ছে না। তবে, ইসরায়েল গোয়েন্দা অভিযান চালাচ্ছে। যার ফলে সারাদেশে আকস্মিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ওই প্রতিবেদনে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন ইউরোপীয় কূটনীতিকের বরাত দিয়ে বলেছে, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দরের কাছে এবং একটি জুতার কারখানায় আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো আগুন ও বিস্ফোরণের কারণ সম্ভবত ইসরায়েল দ্বারা পরিচালিত নাশকতামূলক কাজ।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি (সিআইপি)-এর ইরান বিশেষজ্ঞ নেগার মোর্তাজভি বলেন, ‘আমি মনে করি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এমন একটি কৌশল খুঁজে পেয়েছেন যেখানে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরানকে বিনা বাধায় আক্রমণ করতে সক্ষম।’
এই চলমান গোপন অভিযানগুলো ইরানের নিরাপত্তা ও অবকাঠামোতে ইসরায়েলের ব্যাপক অনুপ্রবেশের ফল। জুনের সংঘাতের শুরুতেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন স্থানীয় গোয়েন্দা এজেন্টদের দল এবং ইরানি ভূখণ্ডের ভেতর থেকে পরিচালিত ড্রোন ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
বিশ্লেষক ও ইরান বিশেষজ্ঞ ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের নেটওয়ার্ক যুদ্ধের সঙ্গে শেষ হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। ইসরায়েল ইরানের মধ্যে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এই ধরনের সব ব্যবস্থার মতোই, এর পেশী মাঝে মাঝে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। কখনও কখনও এটি কৌশলগত কারণে হয় না, বরং এটি একটি উপায় তাদের সক্রিয় রাখা এবং ইরানকে তাদের উপস্থিতি জানানো।’
নেতানিয়াহু, যাকে পূর্বে কিছুটা সংঘাত-বিমুখ মনে করা হতো, তিনি প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং ইরানের ওপর যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হামলা চালিয়েছেন, তা অনেকেই অনুমান করতে পারেননি। একইসঙ্গে তিনি গাজায় নিজের বর্বর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিভাজন বাড়লেও, ইরানের ওপর নতুন আক্রমণ ইসরায়েলের ভেতরে জনপ্রিয় হতে পারে। তবে, তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এটি কতটা ভালোভাবে নেবে, তা বলা মুশকিল।
গোল্ডবার্গ বলেন, ‘ট্রাম্প ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তবে, ইসরায়েল তার কর্মের বিষয়ে তার আঁকা সীমার সঠিক দিকে থাকতে চাইবে। কিন্তু ইরান ইসরায়েলের মধ্যে একটি ঐকমত্যের বিষয়। গাজা নিয়ে মানুষ তর্ক করতে পারে, কিন্তু ইরান নিয়ে নয়। যদি নেতানিয়াহু নিজেকে হুমকির মুখে মনে করেন, তবে তিনি ইরানি কার্ড ব্যবহার করে মানুষকে তার পিছনে একত্রিত করতে চাইবেন।‘
তবে, বিশ্লেষকদের মতে, ইরান এবার সহজে ধরা পড়বে না। মোর্তাজভি আল জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান ইসরায়েলের আগ্রাসন অব্যাহত রাখার ব্যাপারে অবগত। যদিও তারা এখনো কূটনীতির মাধ্যমে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আশা পোষণ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি ইরান জানে, একটি চুক্তি ইসরায়েলি হামলার সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে।’