চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ৪৬ নেতাকর্মীকে শনাক্ত করেছে নগর পুলিশ। এদের মধ্যে ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়নি এক বছরেও। অস্ত্রধারী ২৭ জনও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কর্মকর্তারা বলছেন, আন্দোলন দমাতে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে যেসব অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল। গত বছরের পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে চলে গেছে, পাশাপাশি তাদের অস্ত্রগুলোও ‘হাতবদল’ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো উদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা শুরু করে। তবে প্রথমদিন লোহার রড, লাঠিসোঠা নিয়ে হামলা করা হয়েছিল বলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য। কিন্তু পরদিন ১৬ জুলাই থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা রণমূর্তি নিয়ে সশস্ত্র হয়ে একেবারে প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের ওপর। সেদিন নগরীর ষোলশহরে প্রাণ হারায় তিনজন- ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, ছাত্রশিবিরের কর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত এবং দোকানকর্মী মো. ফারুক।
১৬ জুলাই থেকে সরকার পতনের আগেরদিন ৪ আগস্ট পর্যন্ত নগরীর ষোলশহর, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, নিউমার্কেট মোড়, শাহ আমানত ব্রিজ, বহদ্দারহাটসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় হামলা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। ১৮ জুলাই নগরীর বহদ্দারহাটে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় তরুয়া।
এমনকি ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাসের মধ্যেও গুলিবর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত দু’জন নিহতের অভিযোগে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে।
নগর পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মোট ৬৩টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ১৪টি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নগর পুলিশ হামলার ঘটনাগুলোর ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো ৪৬ জনকে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানার বিভিন্ন মামলায় আসামি ২৭ জন, পাঁচলাইশ থানায় চারজন, চান্দগাঁও থানায় ছয়জন, ডবলমুরিং থানায় ছয়জন ও হালিশহর থানায় তিনজন।
উল্লেখযোগ্য অস্ত্রধারীদের মধ্যে ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করা যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মো. দেলোয়ার ও মিঠুন চক্রবর্তী, ছাত্রলীগ কর্মী (বর্তমানে নিষিদ্ধ) এনএইচ মিঠু, হাবিবুর রহমান আহনাফ ও যুবলীগ কর্মী মো. জাফরকে শনাক্ত করা হয়েছে। ১৮ জুলাই নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় হামলাকারী মহিউদ্দিন ফরহাদ, মো. জালাল ওরফে ড্রিল জালাল, মো. তৌহিদুল ইসলাম ফরিদ, ছাত্রলীগ কর্মী ঋভু মজুমদার ও যুবলীগ কর্মী মো. জামালকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া, প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়া মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিউদ্দিন মাহমুদ ও মো. দেলোয়ার, যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ ফরিদ, মোহাম্মদ জাফর, এইচএম মিঠু ও সোলেমান বাদশা এবং ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ তাহসিন, ইমরান আলী মাসুদ ও মনসুর আলীকে শনাক্ত করা হয়।
নগর পুলিশের তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী হামলার ঘটনায় করা ৬৩ মামলায় চলতি বছরের ১৮ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ ১ হাজার ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে অস্ত্রধারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া আছে ১৯ জন। এদের মধ্যে কোতোয়ালি থানার মামলায় ১১ জন, পাঁচলাইশ থানার মামলায় দু’জন, চান্দগাঁও থানার মামলায় তিনজন, ডবলমুরিং থানার মামলায় দু’জন এবং হালিশহর থানার মামলায় একজন আছেন।
একবছরে অস্ত্র উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ মাত্র দু’টি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকা থেকে ইমরান আলী মাসুদ ও মনসুর আলীকে দুটি গুলিভর্তি বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। সেই পিস্তল দুটি ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল বলে পুলিশের ভাষ্য।
গত বছরের ৪ আগস্ট নগরীর বহদ্দারহাটে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় মোট তিনজনকে গ্রেফতার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। এর মধ্যে গত বছরের ২২ নভেম্বর সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করা হয় তৌহিদুল ইসলাম ফরিদকে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি ওয়ান শ্যূটারগান নিয়ে তৌহিদুল একাই ছাত্র-জনতার ওপর ২৮ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। তার জবানবন্দিতে নাম পেয়ে পুলিশ চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি ঋভু মজুমদার ও মো. জামালকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানিয়েছিল, তারা দুটি বিদেশি পিস্তল নিয়ে তৌহিদুলের সঙ্গে হামলায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়নি।
১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করা যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজকে গত বছরের ২৪ অক্টোবর ফেনী থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। এর দু’দিন আগে ২২ অক্টোবর খুলশী থানা পুলিশ গ্রেফতার করে ছাত্রলীগ কর্মী আহনাফকে, যে নগরীর মুরাদপুরে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়েছিল। তবে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করা নগরীর চকবাজার ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিঠুন চক্রবর্তীকে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ফেনী থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলার ভিডিও ফুটেজে তাকে পিস্তল হাতে দেখা গিয়েছিল। সেটি একটি বিদেশি পিস্তল ছিল। তবে সেটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
সূত্রমতে, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তৌহিদুল ইসলাম ফরিদ ও মিঠুন চক্রবর্তী জানিয়েছিল, তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো তারা নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার যুবলীগ ক্যাডার মো. আনিসের কাছ থেকে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেগুলো আবার তাকে ফেরত দিয়েছে। গত বছরের ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর অনন্যা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে আনিসসহ দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বর্তমানে কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের অনুসারী সন্ত্রাসীরা তাদের খুন করে বলে পুলিশের ভাষ্য।
অন্যদিকে গ্রেফতার হওয়া ঋভু মজুমদার পুলিশকে জানায়, তার ব্যবহৃত অস্ত্র সে যুবলীগ ক্যাডার মহিউদ্দিন ফরহাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল। পরে আবার সেটি তাকে ফেরত দেয়। ঋভু মজুমদারের সঙ্গে ওই মহিউদ্দিন ফরহাদও গত বছরের ৪ আগস্ট নগরীর বহদ্দারহাটে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে শনাক্ত হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাহমুদা বেগম সোনিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে যাদের দেখা গেছে, এমন ৪৬ জন শনাক্ত হয়েছে। ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাঁচ আগস্টের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোও বিভিন্ন হাতবদল হয়েছে। এজন্য সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে কিছুটা সময় লাগছে। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’