চট্টগ্রাম ব্যুরো: জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা বিএনপির হলেও সেটি আলোচনায় আসছে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তবে এ নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ করে কোনো বিভাজন তৈরির পক্ষে নয় বিএনপি, এ কথাও জানিয়েছেন তিনি।
শনিবার (২৬ জুলাই) বিকেলে নগরীর জিইসি কনভেনশন সেন্টারে ‘জুলাই-আগস্ট গনঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির আলোচনা সভা ও পেশাজীবী সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, চট্টগ্রাম শাখা এ আয়োজন করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ’১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে, আমাদের (বিএনপি) এত মানুষের যে আত্মত্যাগ, সেটা এখন আবার অনেকে ভুলে যেতে বসেছে। এখন জুলাই-আগস্ট নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তাতে ১৬ বছর ধরে যে মানুষগুলো একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেটা কিন্তু আলোচনায় আসছে না। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে, পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, চাকরিচ্যুত হয়েছে, বাড়িঘরে থাকতে পারেনি, বেশিরভাগ সময় কোর্ট-কাচারিতে কাটিয়েছে। বলতে কষ্ট হচ্ছে- কারও স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করে চলে গেছে, বছরের পর বছর স্বামী ঘরে না থাকার কারণে, এ রকম ঘটনা আছে। সেগুলো কিন্তু আলোচনায় আসছে না।’
জুলাই আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের কথা বলতে গেলে ১৬ বছরের আন্দোলনে যাদের অবদান আছে, তাদের সবার কথা বলতে হবে এবং এটা শুরু করতে হবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়ে। এই আন্দোলনের এক নম্বর অবদান দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার, এটাও কিন্তু অনেকে বলতে ভুলে গেছে। দেশনায়ক তারেক রহমান বছরের পর বছর এ আন্দোলনের জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছেন, সেই কথাটাও কিন্তু জুলাইয়ের আলোচনায় খুব কম করে আসছে। আসলে এই আন্দোলনের মূল নায়ক তো ছিলেন তারেক রহমান আর সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ যেটা, সেটা করেছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বক্তব্য এটা দিয়েই শুরু করতে হবে, যাদের কারণে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।’
‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের, যুবদলের, শ্রমিক দলের, ছাত্রদলের, স্বেচ্ছাসেবক দলের, সমস্ত অঙ্গসংগঠনের। সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কিত যারা রাজনীতি করেছেন তারা। যারা জেলে গেছে, তাদের নব্বই শতাংশ ছিল বিএনপির। আমার সঙ্গে জেলে বন্দি ছিল কমপক্ষে ১০ হাজারের মতো, সেখানে ৯ হাজার হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মী। আর বাকি এক হাজারের মতো ছিল রিকশাওয়ালা ভাই, ঠেলাওয়ালা ভাই, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মানুষ আছে।’
খসরু বলেন, ‘এই যে চরম কঠিন একটা সময়, আমরা সবাই অতিক্রম করেছি, বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা, এই কথাগুলো জুলাই-আগস্টের আলোচনায় কোথাও আসছে না। শহিদ ওয়াসিমের নামটা পর্যন্ত আমি ঢাকায় কোথাও দেখি না। যে জুলাই আন্দোলনে প্রথম শহিদ ওয়াসিম, তার নামটা কোথাও আলোচনায় নেই।’
আন্দোলনের কৃতিত্ব বিএনপি কখনো এককভাবে দাবি করে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে বিএনপির কথা আলোচনায় আসছে না, এটা নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করিনি। কারণ এই বিপ্লব, এই আন্দোলনকে আমরা বিএনপির কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে চাই না। সমস্ত জাতি, সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়েছে, আমরা সেটাকে সেভাবে দেখাতে চেয়েছি। কৃতিত্বের দাবিদার যে সবচেয়ে বেশি বিএনপি, এটা আজ পর্যন্ত তারেক রহমান সাহেবও বলেননি, আমরাও বলিনি। একটাই কারণ- আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত আমরা করতে চাই না। আন্দোলনে বিভাজন আমরা করতে চাই না। আমরা এ আন্দোলনকে দেশের সকল মানুষের আন্দোলন হিসেবে দেখাতে চেয়েছি, যে কারণে বিএনপি কখনো কৃতিত্ব দাবি করে না এবং করবেও না। এটা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আন্দোলন হিসেবে আমরা আখ্যা দিয়েছি।’
‘আমার সবসময় শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব দাবির কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ করল কারা আর সারাজীবন সেটার কৃতিত্ব দাবি করল শেখ হাসিনা। ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, মহিলারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, অথচ শেখ হাসিনা কৃতিত্ব দাবি করেছে শুধু তার নিজের এবং পরিবারের। এখনো সেই অবস্থা যাতে না হয়, সেজন্য বিএনপি কখনো একক কৃতিত্ব দাবি করছে না। তবে রেকর্ডের জন্য আমাদের নেতাকর্মীদের সবাইকে জানতে হবে।’
শেখ হাসিনা ‘পালানোর পর’ এখন দেশ গড়ার সময় উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এখন আমাদের দেশ গড়ার সময়, জাতি গঠনের সময়। এতদিন শেখ হাসিনার পতন ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। এখন আর সেটা নেই। আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে নেই, আমাদের দেশ গড়তে হবে। নির্বাচনের পর তো আমাদের দেশটাকে গড়তে হবে। জিয়াউর রহমান সাহেব যেভাব দেশ গড়েছেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে দেশ গড়েছেন, তারেক রহমান সাহেব দেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাতির সামনে তুলে ধরছেন, সেই গল্প জনগণকে বলতে হবে, দেশবাসীর সামনে ৩১ দফার গল্প তুলে ধরতে হবে।’
‘তারেক রহমান সাহেব বলছেন রাজনীতিতে সহনশীলতার কথা। ভিন্নমত পোষণ করেও অপরের মতকে সম্মান জানানোর কথা বলছেন। কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে একশ সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। নেতাকর্মীদের বলবো- অপরের সঙ্গে দ্বিমত করেও তার মতের প্রতি সম্মান জানাবেন, অসুবিধা নেই।’
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আগামীর বাংলাদেশের তরুণদের ভবিষ্যত কী হবে, সেই আলোচনা করতে হবে। আমরা এক কোটি তরুণের কর্মসংস্থানের কথা বলছি প্রথম ১৮ মাসে। অনেকে আমাকে বলেন, ১৮ মাসে এক কোটি মানুষকে চাকরি কিভাবে দেবেন? আমি বলি, আমরা কিন্তু এই কথাটা পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট হিসেবে বলছি না, অঙ্কের হিসাব-কিতাব করে বলছি। কোন সেক্টরে কত চাকরি হবে, দেশে কত হবে, বিদেশে কত হবে, আত্মকর্মসংস্থান কত হবে, আমরা সব হিসাব-কিতাব করে বের করেছি। এগুলোর জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় কী কী পরিবর্তন আনবো, সেটাও আমরা রেডি করেছি।’
‘সুতরাং আমরা যা বলছি সেগুলো পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট না, তারেক রহমান সাহেব নীতিনির্ধারকদের নিয়ে কাজগুলো প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছেন। স্বাস্থ্যখাতে কী হবে, শিক্ষাখাতে কী হবে, আইটি সেক্টর, ইন্ডাস্ট্রিতে, কৃষিখাতে কী হবে- সব আমরা হোমওয়ার্ক করে রেখেছি। আমরা এক কোটি চাকরির কথাও আমরা হোমওয়ার্ক করেই বলেছি। এজন্য যেসব এক্সপার্টিজ আছেন, তারাও আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। পলিটিক্যাল স্লোগান দিয়ে দেশ গড়া যাবে না। এখন আমাদের মানুষের কাছে পরিষ্কার করতে হবে যে আমরা কীভাবে আগামীর বাংলাদেশ গড়বো।’
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে এবং আইনজীবী ফোরামের সদস্যসচিব হাসান আলী চৌধুরী ও মহানগর ড্যাবের সাধারণ সম্পাদক ডা. ইফতেখার ইসলাম লিটনের পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নসরুল কদির, এ্যাবের সভাপতি জানে আলম সেলিম, সিএমইউজের সাবেক সভাপতি শামসুল হক হায়দরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহকারী মহাসচিব মুস্তাফা নঈম, বার কাউন্সিলের সদস্য এ এস এম বদরুল আনোয়ার, সিএমইউজের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান।
সমাবেশে ‘আওয়ামী দুঃশাসন’ ও জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।