ঢাকা: সদরঘাটে দাঁড়িয়ে লঞ্চের অপেক্ষায়। কেটেছেন টিকিটও। কিন্তু ফেরা হলো না আপন ঠিকানায়। সময়মতো লঞ্চ ছাড়লেও মাসুদ গাজীর জীবনে নেমে আসে এক অজানা আতঙ্ক। বাড়ি ফেরার বদলে যেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা র্যাবের আয়নাঘরখ্যাত গোপন বন্দিশালায়। দোষ না করেও টানা ৪৫ দিন সইতে হয় নির্মম নির্যাতন। উল্টো করে ঝুলিয়ে পুরো শরীরে বৈদ্যুতিক শকও দেন র্যাব কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি এমনই কিছু ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন ভুক্তভোগী নিজেই। মাসুদের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলায়। বাবার নাম মুক্তার গাজী। গ্রামে থাকা ছোটখাটো দোকানই ছিল তার আয়ের একমাত্র সম্বল। মাঝেসাঝে তাবলিগে যেতেন। আর এ তাবলিগে যাওয়াই কাল হলো তার। অন্ধকার কুটিরে রেখে তার জীবন থেকে দেড় মাসেরও বেশি সময় কেড়ে নেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন মাসুদ। সদরঘাট হয়ে লঞ্চে চড়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সদরঘাট পৌঁছাতেই কথা আছে বলে তার পথ আটকে দাঁড়ান সাদা পোশাকে কিছু লোক। তখনও মাসুদ বুঝতে পারেননি ‘কিছুক্ষণ পরই তার জীবনে এক কালো অধ্যায় নেমে আসবে।’ সাদা পোশাকের লোকদের হাসিমুখেই মাসুদ বলেন, ‘এখনই লঞ্চ ছেড়ে দেবে। চলেন লঞ্চে উঠে কথা বলি।’
প্রতিউত্তরে তারা বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। বাড়ি পরে যেতে পারবেন।’ এসব বলে তারা জোরজবরদস্তি করে মাসুদকে টার্মিনালের ওপরে নিয়ে যান। এর পর তার কাছে থাকা সব জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। এমনকি সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইলের সিমকার্ড খুলে ফেলে। ওপরে আসতেই মাসুদ দেখেন র্যাব-১১ লেখা কয়েকটি গাড়ি। পোশাক পরা কয়েকজন সদস্যও রয়েছেন।
ভুক্তভোগী মাসুদ গাজী বলেন, ‘গাড়িতে তুলে আমার মাথায় থাকা পাগড়ি খুলে ফেলেন র্যাব সদস্যরা। এক পর্যায়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। এ সময় চালকের আসনে থাকা ব্যক্তিকে একজন বলেন- ‘চল সাভারের দিকে। কিন্তু পথে মনে হলো চিটাগাং রোড। কেননা অন্য সব গাড়ি থেকে হাঁকডাক শুনে চিটাগাং রোডই মনো হলো।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে বিকেলে আটক করা হয়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে রাতে র্যাব কার্যালয়ে নেন তারা। এর পর আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে নোট করা হয়। ওই নোটটি পরবর্তী সময়ে আমাকে দেওয়া হয়। এখানে আমার কাছ থেকে যা যা নেওয়া হয়েছিল সব লেখা ছিল। মোট ৪৫ দিন আমাকে গুম করে রাখা হয়।’
র্যাব-১১ এর গোপন বন্দিশালা প্রসঙ্গে এই ভুক্তভোগী বলেন, ‘তাদের বেশ কয়েকটি সেল রয়েছে। তবে তিন ধরনের কক্ষে আমাকে রাখা হয়েছিল। একটি কক্ষ আনুমানিক ছয় ফুট দৈর্ঘ্যের, আর আড়াই ফুট প্রস্থের। এর মধ্যে দুই ফুট কমোড। অল্প একটু জায়গায় থাকা-খাওয়া আর নামাজ আদায় ও ঘুমানোর মতো ছিল। তাদের কাছে কোরআন শরিফ চাইলে দিতেন না। বলতেন মুখস্থ থাকলে পড়েন। এ ছাড়া, নামাজে রুকুতে গেলে আমার পেছনের দিক এক দেয়ালে ও মাথা আরেক দেয়ালে আটকাতো। ওই জায়গাতেই গোসল করতে হতো। পানি না শুকানো পর্যন্ত আর বসতে পারতাম না।’
মাসুদ বলেন, “কক্ষটি টর্চার সেলের পাশে ছিল। অন্য সব বন্দিকে নির্যাতনের সময় বিকট চিৎকার আসতো। তখন আমি আঁতকে উঠতাম। আমাকেও নির্যাতন চালানো হয়েছে। র্যাবের এসপি মশিউর আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিতেন। আর এএসপি আলেপ উদ্দিন পায়ের তালুতে বেশিরভাগ আঘাত করতেন। এ ছাড়া, নির্যাতনের সময় প্রায়ই দাড়িতে হাত দিয়ে এসপি মশিউর বলতেন ‘তোর দাড়ি কেটে ফেলব। তুই বল, তুই কোন দলের সদস্য।’ জবাবে আমি বলি, ‘স্যার আপনারা দেখছেন আমি ইজতেমা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।’ তিনি বলেন ‘না তুই অন্য দল করিস।”
এভাবেই ৪৫ দিন বীভৎস নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সী এই যুবক। এমনকি আটকের তিনদিনের সময় তার পাঞ্জাবি-পাজামা নিয়ে নেন র্যাব সদস্যরা। তাদের দেওয়া পোশাকেই দিন কাটাতে হয়েছিল মাসুদের। যদিও ৪৫ দিনের মাথায় পাঞ্জাবি ফেরত দেওয়া হয়। সেদিন পাঞ্জাবি-পাজামা পরার পর হাতে হাতকড়া ও চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ফের অজানার উদ্দেশে নেওয়া হয় মাসুদকে।
এই যুবক বলেন, “৪৫ দিন পর আমাকে রাজধানীর মাতুয়াইল হাসপাতালের আশপাশে নেওয়া হয়। সেখানে নিতেই তারা হইহুল্লোড় করতে থাকেন। তবে ভেতরে থাকা দুয়েকজন আমাকে আশ্বস্ত করে বলেন- ভয় পাবেন না। আপনাকে কিছু করা হবে না। একটা নাটক সাজিয়ে আপনাকে আবার এদিকে নিয়ে আসবে।’ মূলত এসব সদস্যরা র্যাবের এসব কাজ পছন্দ করতেন না। এর পরও তাদের বিশ্বাস হতো না। কারণ, তারা বলতেন এক আর করতেন আরেক।”
তিনি আরও বলেন, “সেদিন আমাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়নি। এক পর্যায়ে আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করা হয়। কিছুক্ষণ পর ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ বলে আমার হাতে গোলাকৃতির কিছু একটা দেওয়া হয়। ভাবলাম বোমা। কিন্তু চোখ খুললে দেখি বড় একটি মাল্টা। এর পর আবার র্যাব-১১তে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে আমার কাছে তারা মাফ চেয়ে বলেন, ‘কিছু মনে করবেন না ভাই। কষ্ট নেবেন না। বদদোয়া দেবেন না। ওপরের নির্দেশে এমন করতে হয়েছে।’ পরে ছবি তুলে আমাকে আদালতে নেওয়া হয়।”
আদালতে নেওয়ার সময় মাসুদকে কিছু শিখিয়ে দেন র্যাব সদস্যরা। তার নাম ঠিক থাকলেও বাড়িয়ে দেন বয়স। অর্থাৎ ওই সময় ৩৩ এর জায়গায় দেওয়া হয়েছিল ৩৬ বছর। এ ছাড়া, সদরঘাট থেকে ধরলেও ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলে যেন বলা হয় মাতুয়াইল থেকে ধরা পড়েছেন। আর ৪৫ দিন আগে নয়, গতকাল রাতে ধরার কথা বলা হয়। এসব না বললে ফের গোপন বন্দিশালায় নিয়ে নির্যাতন চালানো হবে বলেও হুমকি দেন তারা।
মাসুদ বলেন, “এজলাসে তোলার পর নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে সব খুলে বলি। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। জবাবে বিচারক বললেন, ‘তোমার নাম এজাহারে রয়েছে।’ আমি বললাম, ‘এসবের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’ পরে এজাহারে দেখি শুধু আমার নাম। বাবার নাম অজ্ঞাত। ঠিকানাও অজ্ঞাত। একপর্যায়ে আবার তিনদিনের রিমান্ড দিয়ে আমাকে কারাগারে পাঠান বিচারক।”
তিনি বলেন, “আমার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালিয়েছেন এএসপি আলেপ ও মশিউর। তারা উল্টো করে ঝুলিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিতেন। পায়ের তালুতে বেধম পেটাতেন। আর বলতেন- ‘আমরা যা শিখিয়ে দেবো তাই বলবি।’ তবে তাদের মধ্যে কিছু ভালো লোক ছিলেন। নির্যাতনের পর তারা এসে আমাকে বলতেন- ‘তারা যত কথাই বলুক, আপনি কোনো কিছু স্বীকার করবেন না। তারা আপনাকে ফাঁসিয়ে বড় পদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।’ এককথায় ২০১৯ সালে র্যাব-১১ এ কর্মরত বড় কর্মকর্তাদের সবাই আমাকে নির্যাতন করেছেন।”
মাসুদকে আটকের অভিযোগে লেখা হয়, ২০১৮ সালের শেষদিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কোনো এক জায়গায় নাশকতার উদ্দেশ্যে মাসুদসহ কয়েকজন একত্রিত হয়েছিল। অথচ তাদের কাউকেই চিনেন না বলে জানান এই ভুক্তভোগী। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এডিশনাল এসপি আলেপসহ পাঁচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ করা হয়। ভয়েস অব ইনফোর্স ডিসাপেয়ারড পারসনস-ভয়েড-এর মাধ্যমে এ অভিযোগ করেন তিনি।