Sunday 27 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
ডিবি হেফাজতে আরও ২ সমন্বয়ক, হত্যাকাণ্ড বন্ধে মুখ খুললেন ড. ইউনূস

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৭ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৫ | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৭

জুলাইয়ের দিনলিপি। ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি সংকটময় দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে নেয়। এর আগের দিন ২৬ জুলাই বিকেলে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকেও ডিবি তুলে নেয়।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ‘তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই’ এই ব্যবস্থা। কিন্তু আন্দোলনকারীরা একে বলেন ‘দমননীতি’। এর পর ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে সাময়িক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

বিজ্ঞাপন

তপ্ত রাজপথ থেকে হাসপাতালের বিছানায়

কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তাল দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাস। দীর্ঘদিনের দাবি, সুনির্দিষ্ট কমিশন গঠন করে যুগোপযোগী কোটা ব্যবস্থা। আদালতের রায়ে প্রজ্ঞাপন জারির পর সরকার দাবি করে, আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এটি আমাদের দাবির চরম অপমান।’ আন্দোলনের অন্যতম মুখ মাহিন সরকার বলেন, ‘সরকার শুধু প্রচারণা চালাচ্ছে, বাস্তবে সমাধান হয়নি কিছুই। আমরা চাইছিলাম একটি স্বাধীন কমিশন।’

শিক্ষার্থীদের ৩ দফা এবং ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

তিন দফা দাবিতে ২৭ জুলাই রাতে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। তারা হুঁশিয়ারি দেন, দাবি না মানলে ‘আরও কঠোর কর্মসূচি’ আসছে। তাদের দাবিগুলো— ১. আটক সব সমন্বয়কের নিঃশর্ত মুক্তি ও দায়মুক্তি; ২. মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং ৩. সংঘাতে জড়িত সবস্তরের দায়ীদের বিচার।

আন্দোলনের নতুন রূপ

সংগঠকরা জানায়, রোববার ২৮ জুলাই থেকে তারা অনলাইন ও অফলাইনে সমানভাবে প্রচারণা চালাবে। দেয়াল লিখন, আন্তর্জাতিক দূতাবাসে স্মারকলিপি, এমনকি ‘হেলথ ফোর্স’ ও ‘লিগ্যাল ফোর্স’ গঠনের মতো সংগঠিত পদক্ষেপও নেওয়া হবে। আন্দোলনকারীদের ভাষ্যমতে, সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২৬৬ জন নিহত এবং সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছেন। ঢাকায় শুধু পুলিশের দায়ের করা মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৭টি।

দমন-পীড়ন ও আটক

শনিবার রাত পর্যন্ত কোটা আন্দোলনের সময় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারাদেশে ৭৩৬টি’র বেশি মামলা হয়। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ২০৭টি মামলায় গ্রেফতার হয় ২ হাজার ৫৩৬ জন। এর বাইরে র‌্যাবের অভিযানে ঢাকায় গ্রেফতার হয় ৭১ জন। সব মিলিয়ে সারাদেশে গ্রেফতার সাত হাজার ছাড়ায়। ঢাকাসহ সারাদেশের যেসব মামলা হয় তার বেশিরভাগ মামলার বাদী পুলিশ।

শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ ও সমর্থন

ডিবির হাতে সমন্বয়কারীদের নেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যরা। তারা ২৭ জুলাই ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত হলেও প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। এদিকে, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি হয়রানি বন্ধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানায়।

হত্যাকাণ্ড বন্ধে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা চান ড. মুহাম্মদ ইউনূস

এদিন প্রথম দেশের কোটা আন্দোলন ইস্যুতে কথা বলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের সংকট উত্তরণের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বল্প সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে মত দেন তিনি। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে একটি প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণের নির্দেশনায় গণতন্ত্রের সমস্যার প্রতিকার সম্ভব। কারণ, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সরকারে থাকা কিছু মানুষের জন্য নয়।’ এ ছাড়া, বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধে তিনি বিদেশিদের সহায়তার আহ্বান জানান।

উদ্বেগ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১৪টি মিশনের যৌথ চিঠি

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে কয়েক দিনের সংঘাতে প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় ঢাকায় অবস্থিত ১৪টি মিশন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কাছে লেখা এক যৌথ চিঠিতে গভীরভ উদ্বিগ্ন ও মর্মাহতের কথা জানায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যৌথ চিঠিটি পাঠায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দূতাবাস।

দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সহিংসতা ও বর্তমান ঘটনা প্রবাহে গভীর উদ্বেগ জানায় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে লেখা এক চিঠিতে এ উদ্বেগ জানান তারা। সেইসঙ্গে তারা এ বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। বিশিষ্ট ১৪০ ব্যক্তি এ চিঠিতে সই করেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতায় আহতদের দেখতে যান পঙ্গু হাসপাতালে। পরে শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত সেতুভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন। তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ক্ষয়ক্ষতিও ঘুরে দেখেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংসের ফলে কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন একবছরের মধ্যে সচল করা সম্ভব নয়।’

বিপরীতে বিরোধীদল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির একটি অংশ সরকারের পদত্যাগ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনে অভিযুক্তদের বিচারের দাবি তোলে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিরোধীদের দমন করতে সরকার মধ্যযুগীয় কৌশল নিচ্ছে।’ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ২৬ জুলাই গভীর রাতে হাতিরঝিলের বাসা থেকে আটক করা হয় ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে।

ছাত্রদের গ্রেফতারকে ‘নজিরবিহীন’ বলে বাম সংগঠনগুলো

বামগণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, বাংলাদেশ জাসদসহ বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো সমন্বয়কদের গ্রেফতারকে ‘নজিরবিহীন’ বলে অভিহিত করে। তারা অবিলম্বে ডিবি হেফাজতে থাকা শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানায়।

কারফিউ, সেনা মোতায়েন ও জনজীবনের স্বাভাবিকতা সহিংসতা ও অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ চার জেলায় কারফিউ শিথিল করে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বিকেল ৫টার পর সেনা সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। সরকারি অফিসও আংশিকভাবে চালু হয়। ২৮ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত অফিস চলে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত।

যেখানে হাজারো তরুণ-তরুণী ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে’ দাঁড়িয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাদের উদ্বেগ শোনা। ইতিহাস বলবে— দমন দিয়ে দাবির মৃত্যু হয় না। বরং তা আরও শাণিত হয়, আরও বিস্তৃত হয়। আর যে দেশে তরুণরা কাঁধে বইয়ের ব্যাগ আর মুখে বৈষম্যবিরোধী স্লোগান দেয়— সেই দেশ থেমে থাকতে পারে না।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

২৮ জুলাই ২০২৪ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর জুলাই বিপ্লব জুলাইয়ের দিনলিপি হত্যাকাণ্ড

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর