ঢাকা: ২০২৪ সালের ২৯ জুলাইয়ের সকালটা অন্যরকম ছিল। রাজধানীর অলিগলিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে, অফিসের ডেস্কে, এমনকি ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ে অনন্য এক প্রতিবাদের রং ‘লাল’। মুখে ও চোখে বাঁধা লাল কাপড়— নীরবতাই যেন সবচেয়ে জোরালো উচ্চারণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে, নিজেদের ভাষাহীনতা প্রকাশেই এই অনাড়ম্বর অথচ তীব্র প্রতিবাদের সূচনা করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন।
এটি কেবল একটি কর্মসূচি নয়, বরং একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ, বঞ্চনার ইতিহাস এবং অমানবিক দমন-পীড়নের বিপরীতে মানুষের আত্মসম্মান রক্ষার এক দৃশ্যমান অভিব্যক্তি।
শোক বনাম প্রতিরোধ
২৯ জুলাইয়ের এই প্রতিবাদ রাষ্ট্রের ঘোষিত জাতীয় শোকের বিপরীতে দাঁড়ায়। একদিন আগেই সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ জুলাইকে নিহতদের স্মরণে শোক দিবস পালনের ঘোষণা আসে। বলা হয়, কালো ব্যাজ ধারণ, মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডায় প্রার্থনা এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। কিন্তু এর পালটা সুরে, রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারানো শিক্ষার্থীরা বলে ওঠে— এ শোক তাদের নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার মধ্যরাতেই গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে জানান, ‘হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্মম উপহাস করা হচ্ছে।’ সেখান থেকেই উঠে আসে এই বিকল্প কর্মসূচির ডাক। লাল কাপড় বাঁধা প্রতিবাদ, যা রাত ১২টা থেকেই শুরু হয়ে যায়।
ভার্চুয়াল দেয়ালজুড়ে লাল
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স ,সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের ছবি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এই লাল কাপড় আন্দোলনে যুক্ত হন। অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের সদস্যও প্রোফাইল ছবি বদলে প্রতিবাদের সঙ্গে সংহতি জানান। এই কর্মসূচি যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় এক নিঃশব্দ আগ্নেয়গিরি হয়ে বিস্ফোরিত হয়— ‘আমরা ভুলে যাইনি, আমরা ক্ষমা করিনি।’
রাজপথে প্রতিরোধ
২৯ জুলাই রাজপথেও থেমে থাকেনি ছাত্রদের ক্ষোভ। পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত হয়— পল্টন, মিরপুর, সায়েন্সল্যাব, সেগুনবাগিচা। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, যশোর, নোয়াখালী, এমনকি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই প্রতিবাদে অংশ নেন।
কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা বুঝে উঠতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকায়ই কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। অনেক জায়গায় লাঠিচার্জ, ধাওয়া, টিয়ারশেল ছোড়ার খবর পাওয়া যায়। মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব, এমনকি সেনাবাহিনী। রাজধানীর আকাশেও দেখা যায় র্যাবের হেলিকপ্টার টহল।
‘জাতীয় শোক’ নয়, চাই জাতীয় জবাবদিহি
এদিন শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তোলে— যাদের হত্যার বিচার হয়নি, যারা গুম-গ্রেফতারের শিকার, তাদের শোক কিসের? এই ‘শোক’ যেন দায়মুক্তির ঢাল হয়ে উঠছে। এদিনই হাইকোর্ট মন্তব্য করে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে ‘খাওয়ানোর’ ছবি প্রকাশ জাতির সঙ্গে রসিকতা। আদালত তাদের অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেয় এবং আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোরও নির্দেশনা দেয়। অপরদিকে, গণতন্ত্র মঞ্চ ও ৭৪ বিশিষ্ট নাগরিক জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তোলেন। ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ এই অভিধায় তারা সমগ্র পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করেন।
সরকারের পালটা বার্তা ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি
রাতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে উঠে আসে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি, যা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশলের একটি অংশ। বৈঠকে শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘১৪ দলের নেতারা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল ও শিবির তাদের দোসর জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই ১৪ দলের নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াত ও শিবিরকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধে একমত হয়েছেন।’
বিএনপির তৎপরতা
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার কর্তৃক প্রকাশিত চলমান কোটা আন্দোলনে নিহতদের নাম ও সংখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে নিহতের এ সংখ্যা অনেক বেশি।’
নিহতের ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা শিক্ষকদের
চলমান ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাস জুড়ে সংঘটিত নিহতের ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ বলে আখ্যা দেন শিক্ষকরা। এ ছাড়া সারা দেশে হত্যা-গুম-গণগ্রেফতারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক-হয়রানি বন্ধ এবং আটকদের মুক্তির দাবি জানান বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত শতাধিক শিক্ষক। শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিপীড়নবিরোধী সমাবেশ করে শিক্ষকরা।
জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মৃত্যু, গুলিবর্ষণ, গ্রেফতারসহ নির্যাতনের নানা ঘটনার সত্য উদঘাটনে ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করা হয়। সোমবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘গণহত্যার বিচার চাই; গায়েবি মামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন বন্ধ করো’ শীর্ষক আইনজীবীদের এক মানববন্ধন থেকে এই কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ওই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে— ‘এই বিচার জনগণের, রাষ্ট্রের নয়।’
মিডিয়ার ভাষ্য ও সত্যের লড়াই
প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের সংখ্যা সরকার যা বলছে, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি। অধিকাংশ নিহত শিক্ষার্থীই ছিল তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, মেধাবী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে ডিবির কর্মকাণ্ডকে ‘গর্হিত অপরাধ’ আখ্যা দেয়। তাদের মতে, নিরাপত্তা হেফাজতের নামে জোর করে বক্তব্য আদায় জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা।
‘লাল কাপড়’ প্রতিবাদের নতুন রূপ
লাল কাপড় শুধু একটি প্রতিবাদের অংশ নয়, এটি একটি সময়ের দলিল। একটি রাজনৈতিক-সামাজিক মুহূর্তকে সংরক্ষণ করার প্রতীক। এই কাপড় হলো রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার বিপরীতে মানবিক বিবেকের গলায় বাঁধা ঝাণ্ডা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শোক চাপিয়ে দেওয়া যায় না, সেটি অর্জন করতে হয়। সম্মানের মৃত্যু হলে শোক নয়, ক্ষোভ জন্ম নেয়। আর সেই ক্ষোভ কখনো কখনো রূপ নেয় লাল কাপড়ে মোড়া এক স্লোগানহীন চিৎকারে। ২৯ জুলাই ছিল তারই রূপ।