ঢাকা: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করেই গড়ে উঠছে স্কুল। যেখানে অগ্নিকাণ্ড বা বড় কোনো দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের হয়ে আসার নেই বিকল্প ব্যবস্থা। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই জরুরি নির্গমনপথ, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, এমনকি প্রশিক্ষিত কর্মী। ফলে স্কুলগুলো মৃত্যুফাঁদের মতো। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ঝুঁকিতে রয়েছে হাজার হাজার শিশু। ফলে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের উপর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর ফুটে উঠেছে নিরাপত্তাহীনতার বাস্তব চিত্র। দুর্ঘটনাকবলিত দো’তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক রুম ও অফিস। কিন্তু পুরো ভবনে রয়েছে একটিমাত্র সিঁড়ি। যেখানে ছিল না কোনো অতিরিক্ত জরুরি সিঁড়ি কিংবা ফায়ার এক্সিট। এমনকি, স্কুলের বারান্দায় গ্রিল থাকায় বের করা যায়নি শিক্ষার্থীদের। এটি না থাকলে এবং বিকল্প ফায়ার এক্সিট থাকলে হয়তো প্রাণে বাঁচানো যেত অনেক শিশুকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত দুটি নির্গমন পথ, প্রতি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, মাসে অন্তত একবার মহড়া এবং ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব মানা হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর প্রায় ৮০ ভাগ স্কুলে নেই বের হওয়ার কোনো বিকল্প পথ। স্কুলগুলোতে থাকছে একটিমাত্র সিঁড়ি। নেই জরুরি নির্গমনপথ ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। স্কুলগুলোর বারান্দা পুরোটাই গ্রিল দিয়ে আটকানো। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে ওই গ্রিলগুলো প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে উদ্ধারকাজে। এমনকি, স্কুলগুলোর ছাদও আটকানো থাকায় দুর্ঘটনার সময় সেখানেও আশ্রয় নিতে পারবে না শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া, কিছু স্কুল আবাসিক ভবনের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে চালানো হচ্ছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি থাকছে উপেক্ষিত।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক মতো আছে কিনা সেটি দেখার জন্য রাজউক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে। যৌথভাবে তারা যদি একটি টিম গঠন করে মনিটরিং করে তাহলে হয়তো পরিবেশ ফিরতে পারে। যারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিকভাবে পূরণ করতে পারবে না তাদের রেজিট্রেশনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যদি নিরাপদ না থাকে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত। নিরাপত্তার প্রশ্নে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয় সেই প্রতিষ্ঠান দরকার নাই। ধারাবাহিক মনিটরিং থাকলে এসব প্রতিষ্ঠানও তৎপর থাকবে। আর ফ্লাইং জোনে মাইলস্টোনের যে ভবন গড়ে তোলা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। মাইলস্টোন ট্রাজেডির মাধ্যমেই আজ আমাদের এই বিষয়গুলো উপলব্ধি হচ্ছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্র এই উপলব্দি থেকে যথাযথভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিরাপদ করবে। এতে অবিভাবকরা স্বস্তিতে থাকতে পারবে।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, স্কুলের ভবন দেখে তারা নিজেই আতঙ্কিত। বেশিরভাগই স্কুলে কোনো নির্গমনপথ নেই। শিক্ষকদেরও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। কোনোদিন যদি বড় কিছু ঘটে, বাচ্চাদের জীবন নিয়ে হয়তো আর ফেরার পথ থাকবে না। তার পরও আতঙ্কের মধ্যে প্রতিদিন সন্তানকে স্কুলে পাঠান তারা।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি বহুতল ভবনে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্গমনপথ থাকা বাধ্যতামূলক। স্কুলে এটি আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ, শিশুদের দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামানো কঠিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাধিক নির্গমনপথ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও সচেতনতামূলক মহড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। আইন থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এখনই প্রয়োজন একটি জাতীয় নিরাপত্তা গাইডলাইন। তা না হলে ভবিষ্যতের কোনো দুর্ঘটনায় ঘটতে পারে হৃদয়বিদারক বিপর্যয়।
মাইলস্টোন ট্রাজেডির মাধ্যমে বোঝা গেছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাইলস্টোন স্কুলটির কথা চিন্তা করেন, বের হওয়ার জন্য ভবনটিতে বিকল্প কোনো পথ ছিল না। স্কুলটিতে একটিমাত্র পথ রয়েছে। বারান্দাগুলো গ্রিল দিয়ে খাঁচার মতো আটকানো ছিল। এটি না থাকলে অনেক শিক্ষার্থীকে বাঁচানো যেত। এটি শিক্ষামন্ত্রণালয় ও রাজউকের দেখার কথা। কিন্তু দিনের পর দিন কারও কোনো নজরদারি নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার নামে আসলে মৃত্যুকূপ তৈরি করা হয়েছে। লোভের বলির কারণে আমাদের স্কুল অনিরাপদ। রাজধানীর বেশিরভাগ স্কুলেই বের হওয়ার কোনো বিকল্প পথ নেই। ঢাকার বেশিরভাগ আবাসিক ভবনগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের নিরাপদ জায়গায় পাঠাতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়। অথচ, সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবে তা যেন ধীরে ধীরে বিপদের ফাঁদে পরিণত হচ্ছে।’
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন বাঁচাতে অবিলম্বে কঠোর নীতিমালা ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করেন আদিল মোহাম্মদ খান।