ঢাকা: ভুয়া নিয়োগপত্র, মিথ্যা তথ্য ও জাল ব্যাংক স্টেটমেন্টের কারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশি ভিসা আবেদন প্রত্যাখানের হার বাড়ছে। এ ছাড়া, বিদেশ যাওয়ার পর মেয়াদের বেশি সময় অবস্থান করার কারণেও বিশ্বের বহু দেশে ভিসা আবেদন করে বঞ্চিত হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এতে একদিকে যেমন দেশের সুনামহানি হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমবাজার থেকে শুরু করে পর্যটন ট্যুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর যৌক্তিক কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের কোনো কিছু করারও থাকছে না। সবমিলিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু নয়, মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতেও ভিসা ইস্যুর পরিমাণ কমছে। চাকরির ক্ষেত্রে ইতালির ভিসা ইস্যু প্রায় বন্ধই রয়েছে। মূলত ভুয়া ও জাল সনদ এবং চাকরির নিয়োগপত্র জালিয়াতির অভিযোগে দেশটি বলতে গেলে বাংলাদেশ থেকে মানুষ নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। লোকবল সংকট থাকলেও ভুয়া তথ্য দিয়ে সেখানে অবস্থানের বিরুদ্ধে দেশটির সরকার। ইতালির ভিসা প্রদানে কারিগরি সহায়তা দেয় ভিএফএস গ্লোবাল। সংস্থাটি জানিয়েছে, মূল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতেই সময় লাগছে। ফলে দীর্ঘদিনের জট লেগে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ভিসা প্রত্যাখানের হার এত বেশি যে, এটি নিয়ে বিব্রত বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও। ভিসা প্রত্যাহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘কোন দেশ কাকে ভিসা দেবে সেটা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশিদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ জাল তথ্য দিয়ে আবেদন।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘একজনের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য বাকিদেরও সমস্যা হয়। মিশনগুলো যখন দেখে বাংলাদেশিরা জাল তথ্য দিয়ে আবেদন করছে। তখন ত্রুটিপূর্ণ আবেদনগুলো নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় লাগছে। ভুয়া নিয়োগপত্র দাখিলের কারণে ভিসা প্রত্যাহারের হার আগের চেয়ে বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা জাল সনদে আবেদনকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারছি না। জাল তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে ভালো হতো।’
ভিসা প্রত্যাখান বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের আচার-আচরণ ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আবেদনকারীদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে সম্প্রতি এক বাংলাদেশি শ্রমিক নিজের কোম্পানির মালিককে গলাকেটে হত্যা করেছে। গুটিকয়েক প্রবাসীর কারণে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপর প্রভাব পড়ছে।’ প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা এবং নিজেদের আচার-আচরণ পরিবর্তনের আহবানও জানান তিনি।
গত ২ জুলাই এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘ভিসা জটিলতার অন্যতম কারণ জাল সনদ ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট। কারণ, অনেক সময় বিবাহিতদের অবিবাহিত বলে আবেদনে উল্লেখসহ নানাধরনের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে বাংলাদেশিদের। শুধুমাত্র ভুল তথ্য নয়, নিজেকে অতিরঞ্জত করে দেখানোর মতো ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে। দ্রুত এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকতা, ট্যুর অপারেটর ও ভিসা আবেদনকারীদের তথ্যমতে, বাংলাদেশিদের ভিসা আবেদন উদ্বেগজনক হারে প্রত্যাখ্যান করছে প্রায় এক ডজন দেশের মিশন। আরও প্রায় এক ডজন দেশ ভিসা প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর করে দিয়েছে। কেউ কেউ শর্তাবলী এতটাই কঠোর করেছে যে, ভিসা পাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, উপসাগরীয় অঞ্চল ও মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও মালয়েশিয়া— বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তিনটি শ্রমবাজার। এখন তারা আর অদক্ষ কর্মীদের ভিসা দিচ্ছে না। নিয়োগ কেলেঙ্কারি, জাল নথি ও অভিবাসীকর্মীদের মধ্যে শ্রম অসন্তোষের অভিযোগের পর এসব দেশের কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পাশাপাশি থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোতে ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
একইভাবে ইউরোপের দেশগুলোতেও ভিসা দেওয়ার হার কমছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাস যাচাইয়ের মাধ্যমে ভিসা ইস্যু করছে। সেখানে ভিসা প্রদানের হার কমছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত সীমিত পরিসরে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র মেডিকেল ও বিশেষ ভিসা দিচ্ছে দেশটির বাংলাদেশ মিশন। সবমিলিয়ে সীমিত হচ্ছে বাংলাদেশিদের বিদেশ গন্তব্য।
জানা গেছে, কয়েকবছর আগেও ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় যেতে বাংলাদেশিদের কোনো ভিসা লাগতো না। এক্ষেত্রে অন অ্যারাইভাল ভিসা বা ইমিগ্রেশন অ্যাপ্রুভাল নিয়েই দেশ দু’টি ভ্রমণ করা যেত। বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা অনুমোদনে নানা শর্ত ও জটিলতা বাড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াও। এ তিন দেশের অনেক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হচ্ছে। যারা বেশ কয়েকবার এসব দেশ ভ্রমণ করেছেন তাদের ভিসা আবেদনও অনুমোদন হচ্ছে না। বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যুর জন্য নতুন অনেক শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য থাইল্যান্ডের ভিসাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও সহজ ছিল। চাইলেই ভিসা পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে থাইল্যান্ডের চিকিৎসা ও ভ্রমণ ভিসাও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিলম্ব হচ্ছে। এমনকি বর্তমানে দেশটিতে ভিসা প্রত্যাখানের ঘটনাও ঘটছে। ভারতে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেন নাহিদ হোসেন। কিন্তু বর্তমানে ভিসা জটিলতার কারণে তিনি থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য ভিসা আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তার ভিসা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। তাই জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও তিনি নিতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে, থাইল্যান্ডের ভিসাও কঠিন হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্য।
বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুসারে, শুধু ২০২৪ সালেই ইইউয়ের সদস্য দেশগুলো ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বছর সংখ্যাটি আরও বাড়বে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বোটফ) জানিয়েছে, গত একবছরে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন পর্যটন ৫০-৬০ শতাংশ কমে গেছে, আর করপোরেট ভ্রমণ কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
কয়েকমাস ধরে যোগাযোগের পরেও ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিধিনিষেধ তুলে নেয়নি। অন্যদিকে নিয়োগে অনিয়ম ও অভিবাসীদের অসদাচরণের কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ওমান, মালয়েশিয়া ও বাহরাইনের দরজা বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়িক ভ্রমণের জন্য একসময়ের পছন্দের গন্তব্য মিশর ভিসা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
গত পাঁচ মাসে শুধু কম্বোডিয়া ই-ভিসা ফের চালু করেছে। কিন্তু ফি করেছে প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশি আবেদনকারীদের জন্য ভিয়েতনাম ও লাওসের দরজা বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে, ১৮ জুলাই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়েছে, ভিসাপ্রার্থীরা ভুয়া নথিপত্র দাখিল বা তথ্য গোপনের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে আজীবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে। এমনকি দায়ের হতে পারে ফৌজদারি মামলাও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উইংয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ভিয়েতনাম, লাওস ও ইন্দোনেশিয়াসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এটি আমাদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। তবে ভিসানীতি শিথিল করা একাধিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এসব দেশ পদ্ধতিগত ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।’
খাতসংশ্লিষ্টরা এই মন্দাবস্থার জন্য ব্যাপক ভিসা বিধিনিষেধ এবং গতবছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর অতিরিক্ত ভিসা আবেদনকে উল্লেখ করেছেন। তারা প্রধান গন্তব্যগুলোর সঙ্গে চলমান ভিসা সংকট নিরসনে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার আহ্বান জানাচ্ছেন। ভিজিট ভিসায় বিদেশে কর্মী পাঠানো এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তারা।
ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশটির ভিসা নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। যারা নথিপত্রের সব শর্ত পূরণ করেন, তাদের সবাইকেই ভিসা দেওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সারাবাংলার এই প্রতিবেদক এ তথ্য জানান। দূতাবাস এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত ৩০ হাজার ৪৯৮টি ভিসা আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করেছে। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৯৫টি।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের তথ্য বলছে, বহির্গমন পর্যটন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে গেছে। সেইসঙ্গে করপোরেট ভ্রমণও কমেছে ৭০ শতাংশ। নতুন ভিসা জটিলতার কারণে ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো গন্তব্যগুলো জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ফলে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের মতো বিকল্প গন্তব্যে চাপ বেড়েছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি বিমান ভাড়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট থেকে বের হতে হলে সবচেয়ে আগে দরকার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জালিয়াতি দমন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ। বিদেশগামী কর্মী ও পর্যটকদের আস্থার সংকট কাটাতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করতে হবে। না হলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভিসাপ্রাপ্তি আরও কঠিন হবে। যার প্রভাব সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।
অভিবাসন ও পর্যটনখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সূচকে (হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স) বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবস্থান এখন উত্তর কোরিয়া কিংবা লিবিয়ার পর্যায়ে রয়েছে। এই কারণেও বাংলাদেশিদের জন্য ভিসার শর্ত ও জটিলতা বাড়ছে।
প্রতিবছর বিশ্বের ১৯৯টি দেশের পাসপোর্ট ও ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্য নিয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত সর্বশেষ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবস্থান ছিল ৯৫তম। বাংলাদেশের ওপরে ৯৪তম স্থানে আছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা উত্তর কোরিয়া। আর বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে একই অবস্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার নাম।