ঢাকা: জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ আবু সাঈদ। তার বুকের তাজা রক্ত ঝরতেই সেসময় বাড়তে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা। দলমত-ধর্ম-বর্ণ ভুলেই রাজপথে নামেন নানান শ্রেণিপেশার মানুষ। সেই গণআন্দোলনের মুখেই ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। আর এ গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একাধিক বিচারকাজ চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার বিচারও চলছে সমানতালে। এ মামলায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে উঠে এসেছে বেরোবির সাবেক প্রক্টর মো. শরিফুল ইসলামের নামও। অন্য অভিযুক্তদের মতো তার প্ররোচনা-সহযোগিতা আর উসকানিতেই আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় আনুষ্ঠানিক অভিযোগে। তবে সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে দাবি শরিফুলের আইনজীবী আমিনুল গণি টিটোর।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার অভিযোগ গঠন নিয়ে মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) আসামিপক্ষের শুনানি হয়। শুনানিতে বেরোবির সাবেক প্রক্টর শরিফুলের অব্যাহতি চান আইনজীবী আমিনুল। তবে লিখিত নয়, মৌখিকভাবেই অব্যাহতির আবেদন করেন তিনি। শুনানির শুরুতেই এ মামলার পেছনের কিছু বর্ণনা তুলে ধরেন এই আইনজীবী।
ট্রাইব্যুনালকে আমিনুল বলেন, ‘আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর রংপুরে একটি মামলা করেছিলেন আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী। মামলায় ১৭ জনের নামসহ অজ্ঞাত হিসেবে ১৩০-১৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল। ওই তালিকায় বেরোবির প্রক্টর শরিফুলের নাম ছিল না। মামলার দেড় মাস পর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরও আসামির অন্তর্ভুক্ত করতে আবেদন করা হয়।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগের আগে করা মামলায় শরিফুলের নাম ছিল না দাবি করে টিটো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কোনো ধরনের আদেশ বা নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ ছিল না শরিফুলের। অথচ সাবেক এই প্রক্টরের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনা-সহযোগিতা ও উসকানির অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঙ্গেও কোনো ধরনের সংযোগ ছিল না তার।’
তিনি বলেন, ‘ফর্মাল চার্জে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সময় উল্লেখ করা হয়েছিল ২টা ১৭ মিনিট। কিন্তু ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছিল ২টা ৪০ মিনিট। তবে ২টা ২৭ মিনিটে নিজের কোয়ার্টারে চলে যান শরিফুল। অর্থাৎ যখন আবু সাঈদ হত্যার শিকার হন, তখন তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। অভিযোগে উল্লিখিত সময়ের ২৩ মিনিট আগেই তিনি ঘটনাস্থল ছাড়েন। এ ছাড়া, ঘটনাটি বেরোবির ভেতরেও ঘটেনি।’ আর এসব কারণেই এ মামলা থেকে অব্যাহতি চান এই আইনজীবী।
আমিনুল গণির উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘মামলার এ পর্যায়ে এসব করার সুযোগ নেই। আপনার সামনেও প্রমাণ করার মতো কিছু নেই। সব ম্যাটেরিয়াল বা উপাদান এলে সব দেখাতে পারবেন। যদি প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ এ সময় শরিফুলের আইনজীবী বলেন, ‘ন্যায্যতার জন্য এসেছি। ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করতে চাই। সততা নিয়ে ৩৬ বছর প্র্যাক্টিস করছি।’
সূত্র বলছে, গেল ১৬ জুলাই আবু সাঈদ হত্যার দিন ঘটনাস্থলে না থাকলেও বেরোবি ক্যাম্পাসে ছিলেন প্রক্টর শরিফুল ইসলাম। হত্যাকাণ্ডের ২৩ মিনিট আগে ঘটনাস্থল ছেড়েই তিনি সেখানে আশ্রয় নেন। ঠিক ওই সময়জুড়ে ক্যাম্পাসের ভেতর অস্ত্রসহ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। ক্যাম্পাসে তাদের আশ্রয় দেন প্রক্টর শরিফুল। কেননা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণে প্রক্টর বা প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়া বহিরাগতরা ঢুকতে পারেন না।
এদিন ট্রাইব্যুনালে আরও দুই আসামির পক্ষে শুনানি হয়। এর মধ্যে কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়ের হয়ে লড়েন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সালাহউদ্দিন রিগ্যান।
সেদিন আকাশও ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে দাবি করেন সালাহউদ্দিন। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে আকাশ জড়িত নন। আর ঘটনাস্থলে না থাকলে উসকানি বা সহযোগিতারও সুযোগ নেই। এ ছাড়া, ফর্মাল চার্জে তাকে ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ তিনি বেরোবি থেকে ২০২২ সালেই অনার্স শেষ করেছিলেন। এমনকি এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রংপুরে করা মামলায়ও আকাশের নাম নেই।’ তাই তার অব্যাহতি চান এই আইনজীবী।
ওই সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আপনি প্রমাণ করেন যে, আকাশ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। প্রমাণ করতে পারলে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া, প্রসিকিউশনও প্রমাণ করতে না পারলে অব্যাহতি দেওয়া হবে।’
এ মামলায় বাকি আসামির বক্তব্য শোনা হবে বুধবার (৩০ জুলাই)। অর্থাৎ অভিযোগ গঠন নিয়ে পলাতক আসামিদের পক্ষে সরকারি খরচে নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীদের শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ এখনও পলাতক রয়েছেন ২৪ জন। তাদের পক্ষে চারজন স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কোন আসামির হয়ে কে লড়বেন, সেসব বুঝিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে এ মামলায় গ্রেফতার রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজের পক্ষে আইনজীবী না থাকায় চার আইনজীবীর মধ্যে একজনকে লড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।