ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর এফ‑৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় সারাদেশে বইছে শোকের ছায়া। এরই মধ্যে বিমানে বিধ্বস্ত স্কুল নিয়ে উঠে এসেছে ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য। অভিযোগ উঠেছে, রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠেছিল বিধ্বস্ত স্কুলের হায়দার আলী ভবনটি। সেইসঙ্গে অননুমোদিত ভবনের বিষয়ে রাজউকের কোনো তদারকি ছিল না বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু মাইলস্টোনই নয়, রাজউককে ম্যানেজ করে ফ্লাইজোনে হাউজিং ও অনুমোদনহীন ভবন গড়ে তোলারও অভিযোগ রয়েছে।
গত ২১ জুলাই দুপুরে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলভবনে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনায় পাইলট, স্কুলে থাকা বহু শিশু শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক হতাহত হন। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু। এ ছাড়া, আহত হয়েছেন শতাধিক। এমনকি, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের মানসিক সেবা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার পর রাজউকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনুমোদনহীন ভবন কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হলো? তবে এ বিষয়ে রাজউকের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার পরপরই বিমানবাহিনী একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একইসঙ্গে নগর উন্নয়ন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও ভবন নির্মাণে অনিয়ম খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
অনুমতিহীনভাবে গড়ে ওঠা মাইলস্টোনের বিধ্বস্ত ভবনটি এতদিন কেন রাউজের চোখে পড়েনি? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভবন তদারকির জন্য রাজউক তৈরি করা হয়েছে। তারা যেহেতু সেটা করেনি তাহলে রাজউকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই ভবনগুলো যখন হয়েছে সেসময়ে রাজউকে যারা ছিলেন তাদের দায়িত্বের গাফিলতি থাকার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজউকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মাইলস্টোনের যে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেটির কোনো অনুমোদন রাজউক থেকে ছিল না। ওই এলাকায় হাউজিংও এবং অন্যান্য ভবনও গড়ে উঠছে। তার মানে, হাউজিংগুলো কাউকে না কাউকে ম্যানেজ করেছে এটাই পরিষ্কার।’
ড. আদিল বলেন, ‘রাজউক কার স্বার্থে বা কোন উদ্দেশ্যে ডিএমডিপি অনুসরণ না করে ফ্লাইং অ্যাপ্রোচ জোনে এসব ভবন করার অনুমোদন দেয়? এই ভবনগুলো করতে রাজউক কেন বাধা দেয়নি? এরসঙ্গে রাষ্ট্রও জড়িত। রাষ্ট্র সঠিকভাবে চললে এই শিশুগুলো মারা যেত না। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর সব রেস্টুরেন্ট নিরাপদ হয়ে যাবে বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু সব আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ইন্টেরিম সরকার না পারলে রাজনৈতিক সরকার এসব সমাধান করতে কতটুকু পারবে?’
পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রানওয়ের পর সাধারণত ৫০০ ফুট এলাকায় কোনো স্থাপনা তৈরি করা যায় না। এরপর ১৩ হাজার ফুটের একটি অংশ অ্যাপ্রোচ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে ১৫০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতার স্থাপনা অনুমোদনযোগ্য হলেও এর ব্যবহার নিয়ে সরকারের কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।’
রাজধানীতে অনুমোদনবিহীন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা আরও ঘটতে পারে এবং শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে ফ্লাই জোন এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বহুতল ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, ফ্লাইং জোনে যুদ্ধবিমানটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় পাইলট বিমান রেখে প্যারাস্যুট দিয়ে নিজে বাঁচতে চেয়েছিলন। কিন্তু প্যারাস্যুট না খোলায় পাশেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি টিনশেড ভবনের চালা ভেঙে ভেতরে পড়েন পাইলট তৌকির। বিমান বিধ্বস্তের প্রায় এক ঘণ্টা পর স্কুলের একটি ঝাউগাছে প্যারাস্যুট দেখে সেখানে গিয়ে তাকে জীবিত শনাক্ত করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান পাইলট তৌকির। কিন্তু ফ্লাইং জোনে যেকোনো সময় যেকোনো বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিধ্বস্ত এই যুদ্ধবিমানটি। যেখানে হয়তো ঘটতো পারে মাইলস্টোনের চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
এ বিষয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা হলে মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল নুরুন নবীর (অব.) সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিধ্বস্ত ভবনটির অনুমোদন ও তদারকির বিষয় নিয়ে জানতে রাজউকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে (ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত নম্বর) এবং রাজউকের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে কয়েকদিন একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।