ঢাকা: ৩১ জুলাই, ২০২৪। দেশজুড়ে ছাত্র-শিক্ষকদের কণ্ঠে একই স্লোগান— ‘বিচার চাই, ন্যায্যতা চাই’। কিন্তু এদিন ‘ন্যায়’ চাইতে গিয়ে ফের রক্তাক্ত হয় রাজপথ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম— বাংলাদেশের প্রতিটি শহর যেন হয়ে ওঠে এক একটি অবরুদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্র।
এক আহ্বান, এক অগ্নিমন্ত্র
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ২৯ জুলাই রাতে টেলিগ্রাম অ্যাপে ঘোষণা করেন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি। লক্ষ্য ছিল নয় দফা দাবি আদায়। যার মধ্যে ছিল সমন্বয়কদের মুক্তি, গুম ও হত্যার বিচার, গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি এবং শিক্ষাঙ্গনে সেনা-পুলিশি হস্তক্ষেপের অবসান। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্ট মাজার গেটে জড়ো হতে শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আইনজীবীরাও নেমে আসেন রাস্তায়। কিন্তু সাড়ে ১২টায় পুলিশ প্রথমবারের মতো লাঠিপেটা ও গ্রেফতার শুরু করে। এর পরই শুরু হয় এক অঘোষিত রাষ্ট্রীয় অভিযান।
ছত্রভঙ্গের নামে সাঁড়াশি
ডিএমপি ও জেলা পুলিশের যৌথ অভিযানে ঢাকার কেন্দ্রস্থল দোয়েল চত্বর ও শহিদ মিনারে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ভেঙে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় তারা ব্যবহার করে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমান এবং অন্যান্য শিক্ষককেও রেহাই দেওয়া হয়নি সেদিন। আওয়ামী লীগ ও পুলিশি হামলায় সারা দেশে অন্তত ৯০ জন আহত হন— এর মধ্যে সাংবাদিকও ছিলেন। শুধুমাত্র ৩১ জুলাইয়ে ৩৪১ জন গ্রেফতার হন। ১৪ দিনে গ্রেফতার ১০ হাজার ৭০০ ছাড়ায়।
জাহাঙ্গীরনগরে প্রতিরোধ, সিলেটে নিপীড়ন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সরব অংশগ্রহণ চোখে পড়ে। নতুন কলাভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসজুড়ে। একই সময়ে সিলেটের শিক্ষার্থীদের মিছিলেও বর্বর হামলা হয়। এ সময় আহত হন অন্তত ২০ জন।
শিল্প ও স্মৃতিচারণে ফোটে প্রতিরোধের ভাষা
১ আগস্ট বৃহস্পতিবার নতুন কর্মসূচি নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন—‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’। চিত্রাঙ্কন, ফেস্টুন, দেওয়াল লিখন, গ্রাফিতি আর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে তারা ফিরে দেখে ৩১ জুলাইয়ের ভয়াল দৃশ্যপট। কর্মসূচি অনুযায়ী বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থী নির্যাতনের ভয়ংকর দিনের স্মৃতিচারণ করে। শহিদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীরা স্মৃতিচারণে অংশ নেন। আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো বিবৃতিতে লেখা হয়—‘আমরা আর ভুলব না, ভুলতে চাই না। এই দিনগুলো শুধু আন্দোলন নয়, জীবনের দাবি, অস্তিত্বের প্রশ্ন।’
আইনজীবীদের দু’পক্ষের পালটাপালটি সংবাদ সম্মেলন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন প্রশ্নে পালটাপালটি সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই পক্ষ। দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে প্রথমে সংগঠনটির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে সমিতির সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক পালটা সংবাদ সম্মেলন করেন।
রাষ্ট্র, কূটনীতি ও চাপের পালাবদল
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও এদিন নতুন বাঁক নেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক একটি চিঠিতে শেখ হাসিনাকে জানান—‘নির্যাতন বন্ধে নিরাপত্তা খাত সংস্কার জরুরি।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে ‘দমন-পীড়ন ও গণগ্রেফতার’ বন্ধের আহ্বান জানান।
শ্রীলঙ্কার মতো সহিংসতা ছড়িয়ে সরকার উৎখাতের চক্রান্ত— ভারতের রাষ্ট্রদূতকে শেখ হাসিনা
৩১ জুলাই বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রদূতকে জানান, ‘সহিংসতাকারীরা আসলে তার (শেখ হাসিনা) সরকারকে উৎখাতের জন্য শ্রীলঙ্কায় যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক সেরকম পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা (নৈরাজ্যকারীরা) শ্রীলঙ্কার মতো সহিংসতা সৃষ্টি করে সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় লিপ্ত।’
গোয়েন্দা পুলিশের বড় পদে রদবদল
৩১ জুলাই বিকেলে বহুল আলোচিত গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার হারুন অর রশীদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন অতিরিক্ত কমিশনার আশরাফুজ্জামান। এর আগেই তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ উঠে আসে।
দেশত্যাগের হিড়িক
দেশের পরিস্থিতি দেখে অনেক প্রভাবশালী দেশ ত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর— যে যেখানে পারেন চলে যান। এই দেশত্যাগ যেন রাষ্ট্রের আতঙ্ককে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দেয়। এদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সচল হতে থাকে।