ঢাকা: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ঘোষিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে নীতিগত সুদের হার (নীতি হার) ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে কমানো হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরসহ ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমলেও তা এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর আবারও চাপ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত: গত জুনে মাসিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এলেও সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাৎসরিক গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশে, যা ২০১৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আগের অর্থবছর এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত নীতি সুদহার বা রেপো রেট ১১ বার বাড়িয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এই হার ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মূল্যস্ফীতি যদি ধারাবাহিকভাবে কমে এবং প্রকৃত সুদের হার তিন শতাংশে পৌঁছায়, তখন ধাপে ধাপে নীতি হার হ্রাস করা হতে পারে। তবে ততদিন পর্যন্ত সুদের বর্তমান হারই বহাল থাকবে।
চলতি বাজেটে ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহনশীল হলেও কড়াকড়ি থাকবে।
এদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম। এর আগের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অপরদিকে, সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ।
নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা- এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক নীতির মূল কৌশল স্থির করেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধে কঠোর আর্থিক নীতি বজায় থাকবে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতি সম্পর্কিত প্রত্যাশা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই চাপের মধ্যে রয়েছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য পৃথক ব্যবস্থা, সম্পদের গুণগত পর্যালোচনা এবং আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি (রিস্ক বেসড সুপারভিশন) চালু।
যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান বাজারসমূহে শুল্কবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে নমনীয়তা এনেছে। বর্তমানে দিনে দু’বার রেফারেন্স বিনিময় হার ঘোষণা করা হচ্ছে, যাতে মুদ্রাবাজারে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা আসে। তবে বিনিময় হারে অতিরিক্ত অস্থিরতা ঠেকাতে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করবে বলে জানিয়েছে।