ঢাকা: দিন যত যাচ্ছে দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনাও বাড়ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সময় দিয়েছেন, সেই নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক দিনও দেরি হবে না। অন্যদিকে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, নির্বাচনের তারিখ খুব দ্রুতই ঘোষণা করা হবে। এই ঘোষণাগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবার হয়তো নির্বাচনের ঘণ্টা বাজতে চলেছে, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা।
এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই সকল প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে আগ্রহী। সংবিধানের কোনো পরিবর্তন না এলে নির্বাচন প্রচলিত নিয়মেই হবে এবং তফসিল নির্বাচনের দুই মাস আগে ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।
তফসিল ও নির্বাচনের তারিখ
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসি সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে এবং ২০২৬ সালের ১০ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই দুটি সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ এখনো চূড়ান্ত না হলেও, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ‘ফুল গিয়ারে’ চলছে।
সম্প্রতি সিইসি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাত শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তাকে জানিয়েছি, আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে ফুল গিয়ারে।”
এদিকে, সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন গত ২৬ জুলাই তফসিল ঘোষণার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সংবিধানে কোনো পরিবর্তন না এলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগের নিয়ম এবং প্রচলিত পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে। সেই সময় নির্বাচনের তারিখ, মনোনয়নপত্র জমাদানের সময়সীমা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য বিস্তারিত জানানো হবে।
নির্বাচন ঘিরে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
ইসি ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের সকল প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে চায়। ইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে নিচ্ছে-
- সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ।
- ভোটার তালিকা প্রকাশ।
- আরপিওসহ আইন ও বিধিমালাগুলো সংশোধন।
- নির্বাচনি সামগ্রী কেনাকাটা।
- নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও প্রার্থী আচরণ বিধিমালা।
- পর্যবেক্ষক নিবন্ধন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার এবং
- নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ।
- ভোটকেন্দ্র নীতিমালা।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ
গত বুধবার ইসি ৩০০ আসনের মাধ্যে ৩৯টি আসনে পরিবর্তন এনে সংসদীয় আসনের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। যে ৩৯ টি আসনে পরিবর্তন এসেছে— পঞ্চগড় -১, ২, রংপুর-৩, সিরাজগঞ্জ -১, ২ সাতক্ষীরা-৩, ৪ শরিয়তপুর- ২, ৩ ঢাকা- ২, ৩, ৭, ১০, ১৪, ১৯, গাজীপুর- ১, ২, ৩, ৫, ৬ নারায়ণগঞ্জ- ৩, ৪, ৫, সিলেট- ১, ৩ ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ২, ৩ কুমিল্লা ১, ২, ১০, ১১, নোয়াখালী ১, ২, ৪, ৫ চট্টগ্রাম- ৭, ৮ ও বাগেরহাট- ২, ৩ আসনের সীমানা পরিবর্তন করা হয়েছে।
ভোটার তালিকা প্রকাশ
প্রস্তুতি হিসেবে আগামী ১০ আগস্ট হালনাগাদ ভোটারের খসড়া এবং ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।
আরপিওসহ আইন ও বিধিমালাগুলো সংশোধন
আগস্টেই নির্বাচন কমিশন পর্যায়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ সংশোধনী চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন। এটি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে।
নির্বাচনি সামগ্রী কেনাকাটা
নির্বাচনি মালামাল সংগ্রহের কাজ চলছে। এ কাজে নির্বাচন কমিশনকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সহযোগিতা করছে।
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও প্রার্থী আচরণ বিধিমালা
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে। অক্টোবরের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নির্বাচনি প্রশিক্ষণ
ভোটের সময় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারসহ সবমিলিয়ে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রায় ৯ লাখ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসির নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান আরজু।
ভোট কেন্দ্র মেরামত
ভোট গ্রহণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ভোট কেন্দ্র মেরামতসহ প্রস্তুত করা হচ্ছে প্রায় ৪৬ হাজার ভোট কেন্দ্র। সাধারণত ভোটগ্রহণের ২৫ দিন আগে ভোটকেন্দ্রের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। এ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সিসিটিভির মাধ্যমে ভোট কেন্দ্র মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের আগে রদবদল
জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মকর্তাদের গণহারে বদলির অংশ হিসেবে চলতি মাসের শেষার্ধ্বে মোট ১৭৪ জন কর্মকর্তাকে বদলি করেছে ইসি। এ ছাড়া বিতর্কিত বিগত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের ভোটে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
নির্বাচনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে নির্বাচনকালীন সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতির ওপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এদের মধ্যে ৫ লাখ ৭০ হাজার থাকবেন আনসার, ১ লাখ ৪১ হাজার থাকবেন পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং প্রায় ৬০ হাজার সেনাসদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকবেন। এ ছাড়া নির্বাচন ঘিরে গুজব ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ‘ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেন্টার’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতির সবগুলো কাজই শুরু হয়েছে আগে থেকেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটগ্রহণ যখনই হোক না কেন, আমাদের প্রস্তুতি আমরা আগেই নিয়ে শেষ করতে চাই। নির্বাচনে আমাদের প্রস্তুতি এগিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেসব কমিটি নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করে যাচ্ছেন। এতে করে নির্বাচনি প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো আরও বেশি বেগমান হয়েছে।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম, ইসির তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি ইস্যুতে সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এখন পর্যন্ত নেওয়া সব কার্যক্রম সেসব উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান। আর এতে আমরা বুঝতেই পারছি ডিসেম্বরের মাঝে তফসিল ঘোষণার জন্য প্রস্তুত কমিশন। সরকার যদি ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন করার ইঙ্গিত দেয়, তাও কমিশন প্রস্তুত রয়েছে বলে আমার মনে হয়।’
তিনি সারাবাংলাকে এই বিষয়ে আরও জানান, ইতিমধ্যে ইসি’র অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মাঝে যথাসময়েই নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনের সব কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। কমিশনের যে সেই সক্ষমতা আছে তার প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে।
আরেক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ আসন্ন নির্বাচন ও দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন সারাবাংলা’র সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যখন সরকার নির্বাচনের জন্য সঠিক সময় মনে করবে সেই সময়েই নির্বাচন করবে। কিন্তু সে সময় তারা নির্ধারণ করবে সেই সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার দায়িত্বও তাদের। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে, কবে নির্বাচন করবো সেই নির্দিষ্ট দিন কোনো দিন আসবে না। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা আছে তার মধ্যে দিয়েই সব রক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান চলছে বলে নির্বাচন দেরি হবে, এমন কোনো কথা নেই। আর এই কথা বলে এড়িয়ে যাবে সুযোগ নেই। সংস্কার এমন একটি বিষয়, যখন সংস্কার প্রয়োজন হবে তখন সংস্কার করতে হবে, নির্বাচনকে দূরে রেখে শুধু সংস্কার নিয়ে থাকলে হবে না।’