যান্ত্রিক নগরীতে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ‘পৌষমেলা’
২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ২১:৫৪
এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : যান্ত্রিক নগরী ঢাকায় বাংলা একাডেমির এক চিলতে সবুজ মাঠে নেমে এসেছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। চলছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পৌষমেলা ১৪২৪।
মেলা প্রাঙ্গণে শনিবার সন্ধ্যায় প্রবেশ করতেই শোনা গেল, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই! কত র’ব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে …’ —জনপ্রিয় এই ভাটিয়ালি গানটি। পৌষমেলায় একদিকে চলছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যভিত্তিক লোকজ গান, ছড়া, কবিতা, সংযাত্রাসহ একাধিক পরিবেশনা।
অন্যদিকে, বাংলা একাডেমির মাঠজুড়ে বসেছে শীতের পিঠা-পুলির হাট। যান্ত্রিক শহরের রোবট মানুষগুলো একটু দম ফেলার জন্য, পরিবার নিয়ে একটুখানি সময় কাটাতে ভীড় করেছে মেলা প্রাঙ্গণে। অধিকাংশই এসেছেন পরিবার এবং বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কিছুটা সময় আনন্দে হৈ হুল্লোড় করে পাড়ি দিতে। ছোট-বড় সকলের পদ-ধ্বনিতে জমজমাট পৌষমেলা ১৪২৪।
ইতিহাস বলছে— পৌষমাস বাঙালির সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের মাস। এই মাসকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা একাধিক উৎসবের আয়োজন করে থাকে। যার মধ্যে পিঠা উৎসব অন্যতম। এই সময়ে কৃষক নতুন ধান গোলায় ভরে। আর কিষাণী মনের আনন্দে নতুন ধানের পিঠা বানায়। যুগ-যুগান্তর ধরে বাংলার গ্রামে গ্রামে এই ঐতিহ্য চলে এলেও এখন তাতে বেশ ভাটা পড়েছে। বিখ্যাত গায়ক মান্না দে’র কণ্ঠে গাওয়া গানটি মনে পড়ছে— ‘পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন, ফিরে আর আসবে কি কখনো…।’
শুধু বাংলাদেশই নয় পৌষ মাসকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। যার মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও নেপাল উল্লেখযোগ্য। তবে একেক দেশে উৎসবের নাম একেক রকম। নাম একেক রকম হলেও মূল বিষয়বস্তু কিন্তু একই। সেটা হচ্ছে, নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ। এই আনন্দে আত্মহারা হয়েই কৃষকের মলিন মুখে হাসি ফুটে ওঠে, বেজে ওঠে কৃষাণীর রিনি-ঝিনি কণ্ঠ।
অতীত ইতিহাস আর ঐতিহ্য বলে, পৌষ মানেই সন্ধ্যায় বাতাসের সঙ্গে বইবে কুয়াশাভেজা হীম বাতাস। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় হু হু কাঁপন। মূলত শীত ঋতুটি এই মাসেই তার হীমের সকল ডালা খুলে দিয়ে প্রকৃতির মাঝে হাজির হয়। এই মাসে পৃথিবীর অনেক দেশেই তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে আসে।
বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে দেখা গেল, যান্ত্রিক শহরে পৌষের কুয়াশাভেজা হীম বাতাস নেই। তবে দেখা পাওয়া গেল, গরম গরম ভাপা পিঠা আর গরম ধোঁয়া।
শুধুই কি ভাপা পিঠা, চারদিকে হরেক রকম পিঠার ম-ম গন্ধ। কী নেই, নকশি পিঠা, তেলের পিঠা, পুলি পিঠা, চিতল পিঠা, পাটিসাপ্টা পিঠাসহ হরেক রকমের নানা রঙের পিঠা। আর এই পিঠাওয়ালারও এসেছেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে। পিঠার পসরা নিয়ে কেউ নোয়াখালী, কেউ নেত্রকোণা, কেউ ঝিনাইদহ, কেউ মানিকগঞ্জ আবার কেউ কুমিল্লা বা রাজশাহী থেকে মেলায় হাজির হয়েছে। ছোট-বড় মোট ৫৫টি পিঠার স্টল বসেছে মেলাতে।
পিঠার পাশাপাশি মেলায় রয়েছে মধুর স্টল। এই শীতকে মোকাবিলার জন্য মধুকে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছে দোকানী। তবে মেলা প্রাঙ্গণের বিশৃঙ্খল পরিবেশও চোখে পড়েছে। সে যাই হোক, হারিয়ে যেতে চলা ঐতিহ্যের হাটে একটু বিশৃঙ্খল পরিবেশ হতেই পারে!
পিঠা উৎসব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় জানালেন, উৎসব শুরু হয়েছে গত শুক্রবার থেকে, চলবে রবিবার পর্যন্ত। মূলত শহরে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীকে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এমন আয়োজন। এই উৎসব আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ।
সারাবাংলা/জেআইএল/আইজেকে