ঢাকা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও চিন্তক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, বৈষম্য থেকে রক্ষা পেতে সমাজের চারটা বৈষম্য দূর করতে হবে। তা হলো- শ্রেণি বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য ও লিঙ্গীয় বৈষম্য।
শনিবার (২ আগস্ট) ‘দ্রোহযাত্রা’র বছরপূর্তিতে অংশ নিয়ে তিনি এ সব কথা বলেন। গতবছরের ২ আগস্ট জুলাই আন্দোলনের সময় ‘দ্রোহযাত্রা’ থেকে দেশজুড়ে প্রাণহানির দায় নিয়ে সরকারকে ‘ক্ষমা চেয়ে’ পদত্যাগের দাবি জানিয়েছিলেন অর্থনীতির এই অধ্যাপক।
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো বিলোপ, ২৪ এর গণহত্যাসহ পাহাড় ও সমতলের সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রতিহতের তিন দাবিতে আজ ‘শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতা’ ব্যানারে ‘দ্রোহযাত্রা’ করেছে প্রগতিশীল ও বামপন্থী দল ও শিক্ষার্থী সংগঠনগুলো।
এদিন দুপুর সাড়ে ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এক সমাবেশ শুরু হয়। জুলাই স্মরণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মূকাভিনয় এবং সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে ‘দ্রোহযাত্রা’ রওনা করে। দ্রোহযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে শুরু করে টিএসসি হয়ে মুক্তি ও গণতন্ত্রের তোড়ন দিয়ে কাঁটাবন হয়ে শাহবাগে এসে শেষ হয়।
দ্রোহযাত্রাপূর্ব সমাবেশে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘গত বছরের দ্রোহযাত্রা সর্বশ্রেণির জনগণের অংশগ্রহণে হয়েছিল। সাংস্কৃতিক জোট, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কসহ অনেকেই সেখানে ছিলেন। তারচেয়েও বেশি ছিলেন চেনা-অচেনা নানা পর্যায়ের জনগণ। তাদের কারণে দ্রোহযাত্রাটি জনগণের সর্বজনীন শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সেই সময়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।’

‘শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতা’ ব্যানারে ‘দ্রোহযাত্রা’ করেছে প্রগতিশীল ও বামপন্থী দল ও শিক্ষার্থী সংগঠনগুলো। ছবি: সংগৃহীত
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান হলো এমন একটা সময় যখন রাষ্ট্রের সব যন্ত্র জনগণের সামনে বিকল হয়ে যায়। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, বিভিন্ন ধারা আছে- সবকিছুই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এমন গণঅভ্যুত্থান আমরা ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ ও ২৪-এ দেখেছি। আমরা তখন জনগণের শক্তি দেখেছি। কিন্তু বিজয়ের সম্ভাবনা দেখেও কখনো বিজয় দেখিনি। বিশ্বাসঘাতকতা ও জনগণের শক্তি ধরে রাখার অক্ষমতার কারণে বিজয় স্থায়ী হতে পারেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্টের পর ৮ অগাস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় আসেন। মানুষের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা কতটা পূরণ হয়েছে? আমি গতবছরের ২ আগস্টেই বলেছিলাম, হাসিনার পতনের মাধ্যমেই জনগণের প্রত্যাশা পূর্ণ হবে না। ইউনুস সরকারের প্রতি সরকারের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল একের পর এক সে প্রত্যাশা ভেঙে এক বছর পালিয়ে বেরিয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘যারা রক্ত দিয়েছে তাদের ও শহিদদের পুরো তালিকা তারা দেয়নি, যারা আহত তাদের চিকিৎসা করতে অনেক সমস্যা তৈরি করেছে। তাছাড়া, যে কাজের জন্যে তারা সরকার গঠন করেছে সে কাজ করতে গিয়ে সরকার যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের ছায়া তাদের উপর পড়েছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম পরিবর্তনের সূচনা। আমরা চেয়েছিলাম শ্রমিকরা তাদের মজুরি পাওয়ার আন্দোলন করলে তারা শ্রমিকদের পাশে থাকবে। কিন্তু তা আমরা দেখছি না। পুলিশ দিয়ে শ্রমিকদের দমন-পীড়ন করা হচ্ছে।’ এ সময় নারী শ্রমিক চম্পা খাতুনকে তিনি শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম শহিদ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘দেশের উপর ভারতের আধিপত্য থাকলে আদানি চুক্তি, রামপাল প্রকল্প, ট্রানজিট নিয়ে চুক্তি কেন প্রকাশ করছেন না? মার্কিনি চুক্তি কেন করছেন? কেন অস্ত্র কিনছেন? কেন বোয়িং বিমান কিনে মার্কিনিদের খুশি করতে হবে? এসব জবাব পেতে হলে দ্রোহযাত্রা অব্যহত রাখতে হবে।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখাতে চায় তারা গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে। একাত্তর আওয়ামী লীগের একার সম্পত্তি নয়। তাদের কবল থেকে একাত্তরকে উদ্ধার করে গণমানুষের কাছে আনতে হবে।’
সমাবেশে আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার মাইকেল চাকমা বলেন, ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে পাহাড়বাসীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছিল। তাই আমাদের হত্যা, মামলা-হামলা গুমের শিকার হতে হয়েছে। এখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা যাওয়ার পর সমতলে কিছু কিছু পরিবর্তন এলেও আমরা আগের জায়গায় রয়ে গেছি। এখনো আমাদের সেই আগের দাবি নিয়েই আন্দোলন করতে হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিদ্রা বলেন, ‘বিভিন্ন জাতির মানুষের কোনো অধিকারের কৃতিত্ব দাবি করতে দেখিনি। রাজনৈতিকদের ক্রেডিটের দাবি দেখতে পেয়েছি। দ্রোহযাত্রা হলো সেই যাত্রা, যা টুকরো টুকরো ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে একসঙ্গে করে প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। এর ক্রেডিট কার? এ ক্রেডিট আমাদের সবারই। যত নিপীড়ন, যত অন্যায় আছে তার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে দ্রোহযাত্রায় মিলিত হয়েছিলাম।’