Friday 12 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট: গতির ঝড় থেকে নিঃশব্দ পতনের গল্প

সুমন বৈদ্য
৩ আগস্ট ২০২৫ ১৮:০২

একটা সময় ছিল, যখন ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামটাই প্রতিপক্ষের জন্য এক আতঙ্কের নাম। সত্তর ও আশির দশকে বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে ক্যারিবিয়ানরা ছিলো একচেটিয়া আধিপত্যের প্রতীক।

মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েইন ড্যানিয়েল, জোয়েল গার্নার কিংবা ম্যালকম মার্শালের মতো গতিদানবরা যখন বোলিং আক্রমণে নামতেন, তখন উইকেটের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটারদের জন্য সেটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের নামান্তর।

তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আসতেন ব্যাটিংয়ের পরাশক্তি—ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স কিংবা পরে এসে ব্রায়ান লারা। সেই যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ছিল শুধুই জয় আর আধিপত্যের অনন্য নাম।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সময়ের সাথে ক্রিকেটও বদলেছে। খেলাধুলার ধরন যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে প্রজন্ম। সেই গতির ঝড় আর অতিমানবীয় ব্যাটিং নৈপুণ্যের উত্তরসূরিরা এসেছেন নতুন রূপে, নতুন গ্ল্যামার আর উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে।

এরপরের প্রজন্মে এসেছিলেন—ড্যারেন সামি, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট, ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, শিবনারায়ণ চন্দরপল, আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনের মতো খেলোয়াড়রা। এরা যেমন ক্লাসিক টেস্ট যুগের ধৈর্যের প্রতীক ছিলেন অন্যদিকে আধুনিক ক্রিকেটের গতি, শক্তি, বিনোদন ও উদ্ভাবনী ধারার অগ্রদূতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

কিন্তু সময়ের পালাবদলে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। ক্রিকেটও ব্যতিক্রম কিছু নয়।
মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েইন ড্যানিয়েল, জোয়েল গার্নারের উত্তরসূরী হয়ে ড্যারেন সামি, কার্লোস ব্র্যাথওয়েট, ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, শিবনারায়ণ চন্দরপল, আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনের মতো খেলোয়াড়রা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ক্রিকেটের আভিজাত্য দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও বর্তমান তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়রা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখতে পারেনি। না আছে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, না আছে ফরম্যাট ভিত্তিক খেলার প্রতি আগ্রহ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই ধারাবাহিকতায় শুধু যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একার যে ভুল রয়েছে তা কিন্তু নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গেলে যেতে হবে অনেক গভীরে। অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার দশা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনদের দাম এখনো আকাশছোঁয়া। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতেই তারাই থাকতেন অবহেলিত অবস্থায়।এরপর থেকে নিয়মিতই সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়মিত খেলে যাচ্ছে অনভিজ্ঞ এবং ফরম্যাট ভিত্তিক খেলোয়াড় ছাড়াই। মোটাদাগে বলতে গেলে উইন্ডিজদের আজকের অবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় ক্রিকেট বোর্ডের।ফলে আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে ।

এবছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক, যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট ওয়ানডে সবকিছুতে মাতিয়ে রাখতো, তারা যেনো আজ এই ফরমেটগুলোতে বড্ড অসহায়। ঘরে বাইরে সব সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী হয়েছে কেবল পরাজয়ের সুখস্মৃতি। আর তাই একসময়ে গতির ঝড় তোলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে নিঃশব্দ পতনের গল্প বলা যেতেই পারে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধুঁকতে থাকা অবস্থাকে অনেকটা ব্যবসা–বাণিজ্যের সাথে তুলনা দেওয়া যেতেই পারে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই আছে যে নামী একটা ব্র্যান্ড বা ব্যবসা সময়ের সঙ্গে নিজেদের না বদলাতে পেরে অথবা কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে না পেরে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থাও এমনই।

ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর স্থবিরতা:

ডমেস্টিক ক্রিকেটই হচ্ছে জাতীয় দলের মূল ভিত্তি, অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন সেই গুণগত মান নেই। যে ডমেস্টিক লিগগুলো থেকে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার তৈরি করার কথা, সেই লিগগুলোতে নেই পর্যাপ্ত স্পন্সর নেই, দর্শক নেই, উন্নত কোচিং বা পরিকাঠামো নেই, সেইসাথে নেই ফিজিওলজিকাল সাপোর্ট।যার কারণে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের উঠে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি যারা উঠে আসেন, তাদের ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠে না।

শুধুমাত্র লীগ খেলা হিসেবে ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিক টুর্নামেন্ট সিপিএল (ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) দিয়ে নামমাত্র বিদেশী ও দেশী খেলোয়াড়দের সংমিশ্রণে নান্দনিকতা বজায় রাখলেও ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আয়োজনের কোনো সুব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই টুর্নামেন্টগুলো হয় অনিয়মিত, অব্যবস্থাপনার শিকার এবং লোকবল ও দর্শকশূন্য। ফলে প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা উঠে এলেও তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়।

প্রশিক্ষণ ও কোচিং কাঠামোর অগ্রগতির অভাব:

আধুনিক ক্রিকেটে খেলোয়াড় তৈরি হয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে—যেখানে উন্নত প্রশিক্ষণ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং মানসিক কোচিং অপরিহার্য। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনেক ক্ষেত্রেই কোচিং স্টাফের অভাব, পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও ডেটা বিশ্লেষণের ঘাটতি, এবং টেকনিক্যাল নির্দেশনার সংকট রয়ে গেছে। ফলে খেলোয়াড়রা সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাচীন কৌশলের ওপর নির্ভর করে থাকে।

বেতন-বিতর্ক:

২০১২ সাল থেকেই নিয়মিত বিরতিতেই সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়া মাঠে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এর পেছনে রয়েছে বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মধ্যে বেতন নিয়ে দ্বন্দ্ব। ২০১২ বিশ্বকাপ জয়ের বোনাস সমানভাবে ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড। যার জের ধরে বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। সেদিনই বলেছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড পচে যাচ্ছে। দ্রুত এর সমাধান না হলে ঘোর অন্ধকার আসতে চলেছে আমাদের ক্রিকেটে। ১৩ বছর পর তা যেনো স্পষ্টভাবে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে ক্লাইভ লয়েডের কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমস্যা কাটেনি একবিন্দু। বরং বেড়েছে।

কিছুদিন পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় চুক্তি থেকে বের করে দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের। ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভোরা ২০১০ সাল থেকেই চুক্তির বাইরে। শুধু বড় টুর্নামেন্টের সময়েই ডাক পড়ে তাঁদের। টুর্নামেন্ট শেষে আইসিসি থেকে প্রাপ্ত অর্থও দিতে ব্যর্থ হয় বোর্ড। বরং খেলোয়াড়দের প্রাপ্ত অর্থ নিজেরাই আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত ছিল তারা। খেলোয়াড়দের কাছে তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলা মানে চ্যারিটি করা। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কজনই-বা আসতে চান?

জাতীয়তাবাদ:

ওয়েস্ট ইন্ডিজ আলাদা কোনো স্বাধীন দেশ নয়। বরং দ্বীপগুলো নিয়ে গঠিত একটি ক্রিকেট বোর্ড। যে কারণে দেশের জন্য খেলার প্রশ্নে অনেকেই থাকেন উদাসীন। নিজের পুরোটা দিয়ে খেলার পরও যখন টাকাপয়সা নিয়ে গড়িমসি করে বোর্ড, তখন খেলার যেটুকু ইচ্ছে থাকে সেটাও মরে যায়। দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে যদি চোটে পড়েন, তাহলে তো আর কথাই নেই। যেখানে নিজেদের প্রাপ্য বেতন পাওয়াই দুষ্কর, সেখানে চোটের পর তার খরচ পাওয়ার আশা করাও বিলাসিতা। যে কারণেই কি না কাইরন পোলার্ড, ড্যারেন ব্রাভো, সুনীল নারাইনদের কালেভদ্রে দেখা যেত ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে। আর সেটাও আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে। কারণ, আইসিসির টুর্নামেন্টই একমাত্র জায়গা যেখানে টাকাপয়সার কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা বিদ্যমান এবং টুর্নামেন্টে নিজেদের মান সম্মান রক্ষার্থে তাদের খেলানো প্রয়োজন মনে করতো বোর্ড।

বোর্ড এবং খেলোয়াড়দের মধ্যকার অন্তকোন্দল:

ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরিবর্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোকে বেছে নিচ্ছেন। যেমন—ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, ডোয়েন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ডের মতো তারকারা ক্যারিয়ারের বড় অংশ কাটিয়েছেন আইপিএল বা অন্য লিগে। কারণ, সেসব লিগে অর্থ বেশি, চাপ কম, আর সম্মাননা অবধারিত। ফলশ্রুতিতে জাতীয় দলের প্রতি তাদের অঙ্গীকার কমে যায়, যা দলীয় সাফল্যে প্রভাব ফেলে।

তাছাড়া ইগো সমস্যার কারণে কঠিন সময়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের যেমন করেছে বঞ্চিত এবং ঠিক তেমনি ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিক খেলার প্রতি আগ্রো বাড়ার কারণে পোলার্ড, হেটমায়ার এর তেমন খেলোয়াড়রা নিজেদের জাতীয় দল থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

এখানে কি শেষ, বেতন ভাতা সমস্যা, প্রাপ্য সম্মান এবং সঠিক পারফর্ম্যান্স এবং গুনাবলী থাকা সত্ত্বেও জুনিয়রদের জায়গা দেওয়ার নাম করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে নামিদামি তারকাদেরকে।

জাতীয় দলে যখন নিয়মিত বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন খেলোয়াড়েরা, তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুহাত মেলে। যেখানে টাকাপয়সার ছড়াছড়ি, চোটে পড়লেও ক্ষতি নেই। বেশির ভাগ সময়েই ফ্র্যাঞ্চাইজিই নিচ্ছে চিকিৎসার ভার। সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ঘোরার সুযোগ। ভ্রমণপাগল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের জন্য এর থেকে বড় সুযোগ কীই-বা হতে পারে? দিনে দিনে তাই জাতীয় দল ছেড়ে টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগ দিচ্ছেন খেলোয়াড়েরা। কারণ, জাতীয় দলে অবস্থান যা-ই হোক না কেন, দিন শেষে হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান চাইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়ই ভরসা। তাই তো বিশ্বে উইন্ডিজের খেলোয়াড়দের নাম হয়েছে ‘টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা’। এর ফলে একদিকে যেমন বোর্ডের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে সেই সাথে দলের অবস্থাও দিনকে দিন খারাপ অবস্থায় পরিণত হচ্ছে, যার ফলে অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে দল সাজাতে হচ্ছে।

নতুন নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আগমনে উইন্ডিজের খেলোয়াড়দের এখন রমরমা অবস্থা। যেখানেই নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হচ্ছে, সেখানেই ডাক পড়ছে তাদের।

খেলোয়াড়দের মনে এমন মনোভাব ঢুকে গিয়েছে যে দলে ভালো করতে না পারলেও ফ্রাঞ্চাইজিস ভিক্তিক খেলায় অংশগ্রহণ করে তাদের নিয়মিত পারফর্মেন্স গুনে মাস শেষে টাকাটা অর্জন করাই যেনো তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে যেমন ফ্রাঞ্চাইজিস ভিক্তিক খেলার মালিক যেমন সন্তুষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে খেলোয়াড়রাও তাদের পকেট বাঁচাতে পেরে খুশিতে মগ্ন থাকছে।তাই জাতীয় দলের খেলা যেন তাদের কাছে যেন একটা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছুই নয়।

তাই দল যেমনই হোক না কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড় মানেই যে বড় ছক্কার আসর তা যেন রপ্ত করে ফেলেছে ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক খেলার মালিকগণ।

একতা ও নেতৃত্বের অভাব:

ওয়েস্ট ইন্ডিজ একটি দ্বীপ-ভিত্তিক দল, যার মধ্যে আছে একাধিক দেশ—জ্যামাইকা, বার্বাডোস, গায়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোসহ আরও অনেক। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় অনুভূতির অভাব থাকে। লিডারশিপ সংকট ও ব্যাটিং-প্রধান দলের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগের অভাব একে আরো দুর্বল করে তোলে। কোর্টনি ওয়ালশ বা ব্রায়ান লারার সময় যে নেতৃত্ব ও সম্মিলিত দলীয় চেতনা ছিল, তা আজ প্রায় অনুপস্থিত।

মানসিক দৃঢ়তার অভাব ও আত্মবিশ্বাসের সংকট:

আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল যেকোনো পরিস্থিতিতে লড়াই করে ফিরে আসতো। তারা হার মানতে জানত না। আজ সেই আগ্রাসী মানসিকতা আর দেখা যায় না। মানসিক দুর্বলতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবই আজ বড় দলগুলোর সামনে তাদের সহজ প্রতিপক্ষ করে তুলেছে। যেমন— একসময়কার ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০২৩ অক্টোবর–নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি।ওয়ানডে সুপার লিগে প্রথম সাত দলের মধ্যে থাকতে না পারা ক্যারিবীয় দল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সুপার সিক্স থেকে বিদায় নিচ্ছে। জিম্বাবুয়ে আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারের পর সুপার সিক্সে গতকাল তারা স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হেরেছে। আর তাতেই নিশ্চিত হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিদায়। সেইসাথে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্বাগতিক দল হয়েও বাদ পড়েছে গ্ৰুপ পর্ব থেকেই।

ফরম্যাট ভিত্তিক খেলার প্রতি অনাগ্রহ:

একটা সময় ছিল যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে উঠে আসা প্রতিটি ক্রিকেটার যেন টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে অনন্য এক প্রতীক হয়ে উঠতেন। উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন শিবনারায়ণ চন্দরপলের মতো ধৈর্যশীল ব্যাটার, আর বোলিংয়ে থাকতেন অবিচল আগ্রাসন আর পরিকল্পনার সমন্বয়। আজ সেই দৃশ্য যেন দূরের এক স্মৃতি। এর পেছনে বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা ও মোহ—যা একদিকে যেমন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে কিছু সফলতা এনে দিয়েছে, অন্যদিকে ধ্বংস করেছে দীর্ঘ ফরম্যাটের শিকড়।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল বর্তমানে এমন একটি ক্রিকেট সংস্কৃতি লালন করছে যেখানে ব্যাট হাতে গিয়ে প্রথম বল থেকেই বড় শট খেলার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আগ্রাসনই যেন একমাত্র উত্তর। অথচ ক্রিকেটের মূল সৌন্দর্য হলো ফরম্যাট অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেওয়া—যেখানে টেস্ট ক্রিকেটে প্রয়োজন ধৈর্য, সংবরণ আর কৌশল, এবং ওয়ানডেতে প্রয়োজন মাপজোক করে গতি তোলার কৌশল। কিন্তু এই দিকগুলো দিনে দিনে বিলীন হচ্ছে।

প্রতিটা ফরম্যাটে আলাদা আলাদা করে খেলোয়াড় থাকা প্রয়োজন, যাতে ইনজুরি প্রবণতা কাটানো যায়, ফরম্যাটের সাথে যেসব খেলোয়াড় অভ্যস্ত তারা সেই হিসেবে নিজেদের ট্রেনিং করার সুযোগ পায়। সেইসব যেসব খেলোয়াড় রেগুলার সব ফরমেটে খেলে থাকে তারাও নিজেদের ব্যাটিং-বোলিং- ফিল্ডিং তিন বিভাগেই নতুনত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগটা পায়।

আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে এমন ব্যাটার কমই দেখা যায় যিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী লম্বা ইনিংস গড়তে পারেন। উইকেটে সেট হয়ে যাওয়ার চেয়ে তারা প্রথম ২০ বলেই শট খেলতে আগ্রহী। ফলাফল—টেস্টে এক-দুই সেশনই টিকতে পারে না ব্যাটিং লাইনআপ, আর ওয়ানডেতে মধ্য ওভারেই হারিয়ে যায় রানের গতি। শিবনারায়ণ চন্দরপল, কার্ল হুপার, বা রামনারেশ সারওয়ান কিংবা দিনেশ রামদীনের মতো ব্যাটার এখন দলেই তৈরি হচ্ছে না।

টি টোয়েন্টির ত্রাস বলা হতো ক্রিস গেইল, মারলন স্যামুয়েলস, কেমার রোচকে, সেইসাথে বাকি ফরম্যাটগুলোতে তাদের আধিপত্য ছিলো বিপক্ষ দলের দিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিমরন হেটমায়ার কিংবা রভম্যান পাওয়েলরা বদলে যান ফরম্যাটের সঙ্গে সঙ্গে। আগের মতো খোলস বদলে মানিয়ে নিতে পারেন না ক্রিকেটে।

টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তার কারণে বোর্ডও অনেক সময় দীর্ঘ ফরম্যাটে আলাদা করে পরিকল্পনা করে না। ঘরোয়া পর্যায়ের ক্রিকেট তো নেই বললেই চলে সেইসাথে লাল বলের ক্রিকেটে বিনিয়োগ কম, কোচিং কম, মিডিয়া কাভারেজও নামমাত্র। ফলে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়রা দীর্ঘ ফরম্যাটে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেই না।

মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়েইন ড্যানিয়েল ব্রায়ান লারাদের প্রথম সোনালী যুগের অবসানের পর দ্বিতীয় সোনালী যুগের সূচনা ঘটায় ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো এবং কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেলের মতো খেলোয়াড়রা।

তাদের দেখে তরুণ প্রজন্মের শিমরন হেটমায়ার, রভম্যান পাওয়েল কিংবা কিমো পলের মতো খেলোয়াড়রা তৃতীয় যুগের সূচনা করবে এমনটাই ভেবেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।

কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের সাথে চির অন্তকোন্দলে বিজ্ঞ খেলোয়াড়দের বাতিল করা, সঠিকভাবে অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের পরিচর্যার অভাব, একনাগাড়ে একই ফরম্যাটে খেলার মন মানসিকতা এবং অতিরিক্ত ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিক খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নতুন করে তৃতীয় যুগের সূচনা করাটাই যেনো অনেক আগেই অন্ধকারেই পথ হারিয়ে বসে আছে।

তাই, তরুণ রক্তদের নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় স্বর্ণযুগের গতির ঝড় তৈরি করতে হলে প্রথমেই দরকার ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটকে টেকসই ও মানসম্পন্ন করে তোলা।প্রতিটি দ্বীপে উন্নত ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম, কোচিং সেন্টার ও স্কাউটিং ইউনিট গড়ে তুলতে হবে।

ডমেস্টিক লিগগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে: ভিডিও অ্যানালাইসিস, পরিসংখ্যান, ডেটা ট্র্যাকিং ইত্যাদি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরাতে পুরনো কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের দিয়ে ডিজিটাল সম্প্রচার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম দৃষ্টি নন্দন বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন তৈরি করতে হবে। এতে করে ঘরোয়া ম্যাচে দর্শক ফিরিয়ে আনা যাবে।

একজন টি-টোয়েন্টি হিটার আর একজন টেস্ট ব্যাটারের প্রোফাইল এক নয়। তাই প্রতিটি ফরম্যাট অনুযায়ী খেলোয়াড় গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। আলাদা হাই পারফরম্যান্স ইউনিট গঠন করা জরুরি—যেখানে টেস্ট, ওডিআই ও টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড আলাদাভাবে প্রস্তুত হবে।

তরুণদের মধ্যে ওয়ানডে, টেস্ট খেলার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে আর্থিক প্রণোদনা ও সম্মানজনক ক্যারিয়ার কাঠামো তৈরি করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড ও খেলোয়াড়দের সম্পর্ক ছিল টানাপোড়েনপূর্ণ। এই বৈরী সম্পর্ক ভাঙতে না পারলে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।

পারিশ্রমিক কাঠামো হালনাগাদ ও স্বচ্ছ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। খেলোয়াড়দের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা এবং নিয়মিত পরামর্শ সভা আয়োজন করতে হবে।

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খারাপ নয়, কিন্তু খেলোয়াড়দের যেন একমাত্র লক্ষ্য না হয়ে দাঁড়ায় ‘আইপিএল খেলা’। বোর্ডকে খেলোয়াড়দের বোঝাতে হবে—জাতীয় দলে খেলা মানেই সম্মান, গর্ব ও দায়িত্ব। বোর্ড চাইলে কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতা ও প্রণোদনার কাঠামো এমনভাবে সাজাতে পারে যাতে খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে প্রাধান্য দেয়।

সোনালী যুগ গড়তে হলে মাঠে একজন দূরদর্শী, সৎ ও স্থিতিশীল অধিনায়ক দরকার, যিনি শুধু ট্যাকটিক্স জানেন না, বরং দলে একতা, শৃঙ্খলা ও অনুপ্রেরণা ছড়াতে পারেন।

ভবিষ্যৎ অধিনায়ক তৈরি করতে হবে অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকেই।তাই ড্যারেন সামির মতো সিনিয়র অধিনায়কের কোচিং এর তত্ত্বাবধানে রেখে সিনিয়র খেলোয়াড়দের মেন্টর করে দলে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। যেমন: লারা, ব্রাভো, পোলার্ড, গেইলদের ক্রিকেট প্রশাসনে বা কোচিংয়ে যুক্ত করা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ কখনোই একটি একক দেশ ছিল না। তাই ‘জাতীয়তা’ নয়, বরং ‘ক্রিকেট ঐক্য’ দিয়েই দল গড়তে হবে। দল গঠনে স্বজনপ্রীতি, দ্বীপভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব কমাতে হবে। বোর্ড ও নির্বাচকমণ্ডলীকে পুরো ক্যারিবিয়ান অঞ্চলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের তৃতীয় সোনালী যুগ তখনই ফিরে আসবে, যখন তারা বাস্তবতা মেনে নিজেদের নতুন করে গড়বে। অতীতকে স্মরণ করে গর্ব করা ঠিক, কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়তে গেলে দরকার পরিকল্পনা, ঐক্য এবং কাঠামোগত বিপ্লব।

অন্যদিকে টি-টোয়েন্টি একটি আধুনিক বাস্তবতা—তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু যখন একটি জাতীয় দল পুরোপুরি এই ফরম্যাটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তা গৌরব ধরে রাখার পথ নয়, বরং দ্রুত পতনের রাস্তা তৈরি করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এখন যেভাবে শুধুমাত্র টি-টোয়েন্টিতে আগ্রহী, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে শিগগিরই তারা টেস্ট বা ওয়ানডে খেলায় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য সময় এসেছে ক্রিকেটের প্রতিটি ফরম্যাটকে গুরুত্ব দিয়ে কাঠামোগত সংস্কার করার। শুধু ছক্কা-চারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে, আবারও সেই ধৈর্যশীল, কৌশলী ও বলিষ্ঠ ক্রিকেটে ফিরে আসতে হবে—যেখানে ক্রিকেটার তৈরি হয় স্বাভাবিক প্রতিভা ও সঠিক পরিশ্রমের সমন্বয়ে।

তাদের হাতে এখনো প্রতিভা আছে, ইতিহাস আছে—শুধু প্রয়োজন একটি দিকনির্দেশনা, একটি সাহসী পদক্ষেপ, এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও ঐক্যবদ্ধ ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তোলা। তাহলেই হয়তো একদিন আবার বিশ্বজুড়ে শোনা যাবে সেই পুরোনো আওয়াজ—
‘Watch out, West Indies are coming!’

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

বিজ্ঞাপন

‘চিঠি দিও’
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:৩২

খুলনায় যুবদল নেতাকে কুপিয়ে জখম
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:২৫

আরো

সম্পর্কিত খবর