Monday 11 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জুলাইয়ের দিনলিপি
‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা, আন্দোলনে দেশজুড়ে নিহত ৯৩

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৪ আগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৯ | আপডেট: ৪ আগস্ট ২০২৫ ১২:৩৭

জুলাইয়ের দিনলিপি। ৪ আগস্ট ২০২৪। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: ৪ আগস্ট ২০২৪, বা ৩৫ জুলাই। ঢাকার আকাশ ছিল ধোঁয়ায় ভরা— কেবল প্রকৃতি নয়, ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ধোঁয়া। অসহযোগ আন্দোলনের সেই রোববার যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রক্তাক্ত এক বাঁক লিখে দিল। এদিন শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সারাদেশে কমপক্ষে ৯৩ জন নিহত হন। রাজধানীজুড়ে অসংখ্য মানুষের আহাজারি, রাজপথে পড়ে থাকা নিথর দেহ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে জড়ো হওয়া স্বজনদের কান্না— সব মিলিয়ে যেন স্বাধীনতার পর সবচেয়ে শোকাবহ একটি দিন। এই দিনেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ঘোষণা করল তাদের সর্বশেষ আহ্বান—‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় থাকব।’

বিজ্ঞাপন

‘দফা এক, দাবি এক— শেখ হাসিনার পদত্যাগ’

বিকেল ৩টায় শাহবাগের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের অন্যতম মুখ নাহিদ ইসলাম বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক— বিজয় ছাড়া কিছু নয়।’ কিন্তু সেই বিজয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরকারের দমননীতি। এদিন দেশজুড়ে শতাধিক প্রাণ ঝরে। শাহবাগে দাঁড়িয়ে যখন ‘আমার ভাই মরল কেন, শেখ হাসিনা জবাব চাই’— এই স্লোগান উঠছিল, তখন ঢামেক থেকে এসে পৌঁছেছে আরও মরদেহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত যে মিছিল গিয়েছিল, তা কেবল রক্তের গল্প বয়ে নিয়ে আসেনি, তা হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের প্রতীক।

অসহযোগের আহ্বান ও দমননীতির পালটা আঘাত

প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করা হলেও, ৩ আগস্টের রাতেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা এগিয়ে আনা হয় একদিন। ৪ আগস্ট ‘সবাই ঢাকায় আসুন’— এই আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, মা-বাবা, শ্রমিক, শিক্ষক, পেশাজীবী— সবাই রাস্তায় নামেন। কিন্তু সরকারের জবাব ছিল বর্বর। প্রথম আঘাত এসেছিল বিক্ষোভকারীদের ওপর নয়, তাদের স্বপ্নের ওপর। টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেট— সবকিছু মিলিয়ে যেন রাষ্ট্র নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে দিচ্ছিল, ‘তোমাদের কণ্ঠ আমি রক্তে ডুবিয়ে দেব।’

সেদিনই ঢাকায় অন্তত ১২ জন নিহত হন। মিরপুর-১০, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি-২৭, মহাখালী, রামপুরা, উত্তরা— ঢাকার প্রতিটি বড় এলাকায় ছিল বিক্ষোভ আর ত্রিমুখী সংঘর্ষ। ঢাকার বাইরের চিত্রও ছিল ভয়ংকর। লক্ষ্মীপুর, ফেনী, রংপুর, সিলেট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ— এ সব জেলায় বিক্ষোভে পড়ে লাশ।

গণভবনের দিকে তাকিয়ে হাজারো চোখ

আন্দোলনের নেতারা সরকারকে শেষবারের মতো সময় দিয়েছিল। নাহিদ ইসলামের কণ্ঠে ছিল হুঁশিয়ারি, ‘যদি আমার ভাইদের বুকে গুলি করা হয়, আমরা চুপ করে বসে থাকব না।’ সেই হুঁশিয়ারি কেবল রাজপথে নয়, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠনের আহ্বান হিসেবেও প্রতিধ্বনিত হয়। আর প্রতিরোধ এসেছিল— শুধু রক্ত দিয়ে নয়, ক্ষোভ দিয়ে। ঢাকার শাহবাগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পলায়ন, বিএসএমএমইউয়ে গাড়িতে আগুন, ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে অগ্নিসংযোগ— সবমিলিয়ে ৪ আগস্ট হয়ে উঠেছিল গণআন্দোলনের এক চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া।

কারফিউ, বন্ধ ইন্টারনেট, তিনদিনের ছুটি ঘোষণা

সন্ধ্যায় সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট, বিশেষ করে ফোর-জি। আন্দোলন থামাতে সরকার তিনদিনের সরকারি ছুটিও ঘোষণা করে— শুধু অফিস বন্ধ নয়, যেন দেশের গণচেতনা বন্ধ করে দেওয়া যায়। কিন্তু সেসব করেও সম্ভব হয়নি। বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ ১৫টিরও বেশি জেলায় কারফিউ ভেঙে মানুষ আন্দোলনে নামে। গুলির মুখে তারা কিন্তু পিছু হটেনি, বরং আরও দৃঢ় হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ও সুশাসনের ডাক

এদিন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দেয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করতে হবে। শেখ হাসিনাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সেই সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘একটি অহিংস ছাত্র আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’

একটি দিনের মৃত্যু নয়, একটি সময়ের জন্ম

৪ আগস্ট ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে রাষ্ট্র বনাম জনগণের সবচেয়ে ভয়ংকর সংঘর্ষের দিন। এই দিনেই প্রমাণিত হয়, ভয় আর গুলি দিয়ে একটি প্রজন্মকে দমিয়ে রাখা যায় না। এই দিন শহরের দেয়াল, হাসপাতালের বারান্দা, রাজপথের ধূলি— সব কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করে— ‘দফা এক, দাবি এক— শেখ হাসিনার পদত্যাগ’।

সারাবাংলা/এফএন/পিটিএম

৩৫ জুলাই ৪ আগস্ট ২০২৪ এক দফা এক দাবি কারফিউ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর মার্চ টু ঢাকা শেখ হাসিনার পদত্যাগ

বিজ্ঞাপন

ঢাকার বাতাসে স্বস্তি
১১ আগস্ট ২০২৫ ০৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর