Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মালয়েশিয়া যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
রোহিঙ্গা ইস্যু ও আসিয়ানে অন্তর্ভুক্তিতে সহযোগিতার অনুরোধ, হতে পারে ৪ চুক্তি

অপূর্ব কুমার, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট
৪ আগস্ট ২০২৫ ১৬:১৭ | আপডেট: ৪ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৫০

ঢাকা: সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে তিনদিনের (১১-১৩ আগস্ট) সফরে মালয়েশিয়া যাবেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বন্ধুর আমন্ত্রণে মালয়েশিয়া সফরে গেলেও রাষ্ট্রীয় এ সফরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান এবং ‘আসিয়ান’ (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট) এর সদস্যপদ লাভে দেশটির সহায়তা চাইবেন তিনি। পাশাপাশি আসন্ন সফরে প্রতিরক্ষা, সেমিকন্ডাক্টর, ফরেন সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)সহ একাধিক ইস্যুতে চারটির মতো দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে আগামী ১১-১৩ আগস্ট রাষ্ট্রীয় সফরে মালয়েশিয়া যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। তার এ সফর উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন কাজ করছে। তারিখ চূড়ান্ত হলেও এখনো কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির সংখ্যা শেষ পর্যন্ত আরও বাড়তে পারে। সফরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে।

জানা যায়, ড. ইউনূসের কুয়ালালামপুর সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি এবং আরও চারটি সমঝোতা স্মারক সই করতে চায় মালয়েশিয়া। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে একটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে এটি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর বাইরে সেমিকন্ডাক্টর, ফরেন সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, গত মাসেই (জুলাই ২০২৫) প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের কথা ছিল। কিন্তু জুলাইয়ে নানা ব্যস্ততার কারণে সরফরটি পিছিয়ে এটি আগস্টে নেওয়া হয়েছে। আসন্ন সফরে কিছু সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। এখনো অনেক সময় বাকি। এ ধরনের ভিভিআইপি ভিজিটে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হয়।

দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো মতে, দুই সরকার প্রধানের অনুষ্ঠেয় বৈঠকে শ্রমবাজার, রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমার ইস্যু, কৃষি, জ্বালানি, শিক্ষা, হালাল অর্থনীতি, সুনীল অর্থনীতি, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

২০২৪ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। ফাইল ছবি

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস পর অক্টোবরে ঢাকা সফর করেছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। ওই সফরটি ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশে কোনো বিদেশি সরকার প্রধানের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর।

সরকারের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বছরে বাণিজ্য প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এটি আরো বাড়ানোর সুযোগ আছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে চায় বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টার সফরে বাণিজ্য-বিনিয়োগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে। শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করছি, ভালো কিছু হবে এই সফরে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি সফরে রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণ এবং আসিয়ানের (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট) সদস্যপদ যাতে বাংলাদেশ পায় সে জন্য মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চাওয়া হবে। রোহিঙ্গা সংকটটি বাংলাদেশের নিজের নয়। তবুও বাংলাদেশকে ভূগতে হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সৃষ্টি করা এই সংকটে।এই সংকটে মালয়েশিয়াও ভুক্তভোগী। মালয়েশিয়াতে কমবেশি ২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। সেই কারণে সংকট মোকাবিলায় দেশটির সহায়তা চাইবেন প্রধান উপদেষ্টা।

মালয়েশিয়া ও মিয়ানমার উভয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ। তাদের নিজেদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট-আসিয়ানের মধ্যে মালয়েশিয়া একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। এই জোটে মিয়ানমারও সদস্য হিসেবে আছে। রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণে আসিয়ানের দেশগুলো বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে। বাংলাদেশ সঠিক প্রথা মেনে এই জোটের সদস্য হতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে। আসন্ন সফরে এ বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে।

সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে শ্রমবাজার নিয়েও আলোচনা হবে। সিন্ডিকেট দুর্নীতির কারণে গত ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জন কর্মী ছাড়পত্র পেলেও ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় যেতে পারেননি। গত অক্টোবরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের ঢাকা সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ওই ১৬ হাজার ৯৭০ জন বাংলাদেশি কর্মী যেন মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যেতে পারেন সংশ্লিষ্টদের সেই নির্দেশনা দেন। যদিও এখন পর্যন্ত তাদের সবাই মালয়েশিয়া যেতে পারেন নি; কিন্তু এ ইস্যুতে দুই দেশ কাজ করছেন। আসন্ন সফরে এই বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে মালয়েশিয়ায় ন্যায্য মজুরিতে কাজ করতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা তার সফরে বিষয়টি বিশেষভাবে উপস্থাপন করবেন। এ ছাড়া সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় যেসব বাংলাদেশি জঙ্গি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের বিষয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কূটনীতিক সারাবাংলাকে বলেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম দুজনই ভালো বন্ধু। মূলত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম তার বন্ধুর জন্যই এর আগে ঢাকা সফর করেন। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ১৫টি দেশের কর্মীরা মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যান। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া বাকিদের ডাবল এন্ট্রি ভিসা দিতো মালয়েশিয়া। এতে বাংলাদেশিদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টির সমাধান করা হয়। এখন বাংলাদেশিরাও ডাবল এন্ট্রি ভিসা পাবেন। এই সময়ে বাংলাদেশের যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সেই প্রয়োজন মেটাতে অধ্যাপক ড. ইউনূস তার নিজের ভাবমূর্তি ব্যবহার করছেন, যা ইতিবাচক। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. ইউনূসকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করছি আসন্ন সফরে সহযোগিতার বিষয়টি আরও খোলাসা হবে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জনশক্তি খাতে সম্পর্ক রয়েছে। আসন্ন সফরের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছি।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বন্ধু হওয়াতে গত বছর প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা সফর করেন। ওই সময়ে জনশক্তি ইস্যুতে এই সফরে ভালো বার্তা পাওয়া গেছে। এবার আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছেন। আসন্ন সফরে জনশক্তি খাতের বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আগেই সহযোগিতা চেয়েছেন। এখন দেখার বিষয় যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়া কীভাবে সহযোগিতা করবে।’

সারাবাংলা/একে/আরএস
বিজ্ঞাপন

আরো