Monday 08 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর জবানবন্দি
‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করলে ‘আপা’ ডাকতে বলেন শেখ হাসিনা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৪ আগস্ট ২০২৫ ২১:৪৪ | আপডেট: ৪ আগস্ট ২০২৫ ২৩:৪১

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

ঢাকা: চব্বিশের ২৬ বা ২৭ জুলাই। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্দেশ্য ছিল জুলাই আন্দোলনে আহতদের দেখা। আর এখানেই চিকিৎসাধীন পুলিশের গুলিতে আহত শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান। তারও খোঁজ নেন সাবেক সরকারপ্রধান। তবে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করতেই ‘আপা’ ডাকতে বলেন একসময়ের দোর্দণ্ড এই প্রতাপশালী।

দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ নিজের জবানবন্দিতে এভাবেই সেদিনের কথা তুলে ধরেন শিক্ষার্থী ইমরান। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। তার সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

বিজ্ঞাপন

বেলা ১১টা ৩৫ মিনিট। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এজলাসে ওঠেন তিন বিচারপতি। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য অনুমতি চান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তবে তার আগেই হুইল চেয়ারে করে ইমরানকে সাক্ষ্য কাঠগড়ায় তোলা হয়। এক পর্যায়ে শপথ পড়ে বসেই নিজের পরিচয়সহ সাক্ষ্য দেন তিনি।

জবানবন্দিতে ইমরান বলেন, ‘আমি গত বছর জুলাইয়ের প্রথম থেকেই কোটাবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯ জুলাই বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় আন্দোলনরত অবস্থায় আমাদের ওপর অতর্কিত গুলি চালায় পুলিশ। এতে আমি গুলিবিদ্ধ হই। আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগে। আরও দুজন সহযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আরও অনেকে আহত হন। তবে আমাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনে আসা সহযোদ্ধারা। কিন্তু কোনো হাসপাতাল আমাকে ভর্তি নেয়নি। অপারগতা প্রকাশ করে প্রাইভেট হাসপাতালও।’

তিনি বলেন, ‘শেষমেশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা আমার পা কেটে ফেলার কথা বলেন। আমিও পা কাটার পক্ষে ছিলাম। কারণ আমার হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত মাংস ছিল না। হাড়ও ছিল না। শুধুমাত্র চামড়া ঝুলে ছিল। কিন্তু আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পা কেটে নেওয়ার অনুমতি দেননি। পরে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিতে বলেন চিকিৎসকরা।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় একটি অ্যাম্বুলেন্সে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়ার সময় ধানমন্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসার সামনে আমাদের আটকায় যৌথবাহিনী। সেখানে এক ঘণ্টা আটকে রেখে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলার মনোভাব ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে আমার সঙ্গে দু’জন রক্তদাতা ও দুই বন্ধু ছিলেন। তখন আমার এক বন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ৫ আগস্টের পর সে ছাড়া পায়। এ ছাড়া, ওই সময় কারফিউ ছিল। এর পর রাত ১১টায় পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে আমার একটি অপারেশন হয়।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘চিকিৎসকরা বুঝতে পারছিলেন না যে, আমার পা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। এক পর্যায়ে হৃদরোগ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা করে দেখে আমার পা বেঁচে আছে। পরে আবার পঙ্গুতে পাঠান চিকিৎসকরা। ওই রাতে আরেকটা অপারেশন হয়। এর মধ্যেই অর্থাৎ ২৬ বা ২৭ জুলাই হাসপাতালে আসেন শেখ হাসিনা। তার আসা উপলক্ষ্যে আগের দিন রাত থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দেয়ালে রং করা, ফ্যান মোছার নামে আমাদের হয়রানি করা হয়। রাতভর কাজ চলায় আমরা ঘুমাতে পারিনি।’

ইমরান বলেন, ‘পরদিন সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের খোঁজখবর নেন। যখন আমার সঙ্গে কথা হয়, তখন আমি তাকে ম্যাডাম বলে ডাকি। তিনি আমাকে আপা বলে ডাকতে বলেন। এ ছাড়া, কোথায় পড়াশোনা করি, হলে থাকি কিনা, কেন থাকি জানতে চান। এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন আমরা আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে আরও জিজ্ঞেস করেন তুমি কি দেখেছো, তোমাকে পুলিশ গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল আমি জানি না। আমার পরও আরও চার-পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।’

পুলিশের গুলিতে আহত এই জুলাই যোদ্ধা বলেন, ‘চলে যাওয়ার সময় হেল্প ডেস্কে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দেন। যা আমি শুনতে পাই। তবে তখন বুঝতে পারিনি এ কথা বলে তিনি কী বুঝিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আমার চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছিল না। আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার কথা থাকতো সকাল ৮টায়। এ জন্য আমাকে আগের দিন রাত ১২টা থেকে পানি পর্যন্ত খেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হতো দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে। আমার পা পচে বিকট দুর্গন্ধ ছড়াতো। গন্ধে আশপাশের লোকজন থাকতে পারতেন না। আমার পায়ের মাংসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বারুদ ঢুকে যায়। এতে হাসপাতালের অ্যান্টিবায়োটিক আমার শরীরে কাজ করছিল না। এরপর আমার পা আরও বেশি পচে যাচ্ছিল। তখন আমার পা থেকে পুঁজ নিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। তখন দামি অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে বলে হাসপাতাল থেকে আমাকে জানানো হয়। তবে হাসপাতালের বাইরের ওষুধ নেওয়ার অনুমতি ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘এ কথা জানতে পেরে রিলিজের জন্য চেষ্টা করেন আমার বাবা। কিন্তু রিলিজ দেওয়া হয়নি। তখন বুঝতে পারি শেখ হাসিনার নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্টের কথা। তারা আমাকে এখানে চিকিৎসা দেবে না, রিলিজও দেবে না। তারা আমার পা কেটে ফেলে জেলে পাঠাতে চেয়েছিল। কেবিনও দেওয়া হয়নি। যথাযথ চিকিৎসা দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে ৫ আগস্টের পর সাধারণ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। এখন যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে। তবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার পায়ে ২৫ বার অপারেশন করা হয়েছে। দীর্ঘ ১১ মাস হাসপাতালে শুয়ে ছিলাম। চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে আমার পায়ের চিকন হাড়টি প্রায় পুরোপুরি নষ্ট। মোটা হাড়েরও ছয় ইঞ্চি নেই।’

শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে ইমরান বলেন, ‘আমার জীবনের এ পরিস্থিতির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কামাল ও পুলিশপ্রধানকে দায়ী করছি।’ এ সময় আদালতের সামনে নিজের গুলিবিদ্ধ পায়ের অবস্থা দেখান ইমরান। পরে তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

এদিন ইমরান ছাড়াও আরেকজন সাক্ষী নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব বর্ণনা তুলে ধরেছেন। এখন পর্যন্ত এ মামলায় তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম