Monday 08 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রাইব্যুনালে নারীর সাক্ষ্য
আমার এই অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের জন্য একমাত্র দায়ী শেখ হাসিনা

রাশেদ মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৪ আগস্ট ২০২৫ ২২:১৭

শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

ঢাকা: ১৮ জুলাই ২০২৪। কাজ শেষে প্রতিদিনের মতো গাড়ির অপেক্ষায় পারভীন। গন্তব্য যাত্রাবাড়ী। তবে সড়কে বাহন না থাকায় হেঁটেই ছুটছেন গন্তব্যের দিকে। যাত্রাবাড়ী পৌঁছতেই দেখেন আহত হয়ে পড়ে আছেন বহু মানুষ। এর মধ্যে এক তরুণকে বাঁচাতে যান তিনি। তাকে টেনেও তোলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। সেই গুলিতে হারাতে হলো নিজের চোখ, এমনকি তলপেটে ছররা গুলি নিয়ে এখনও দিন কাটাতে হচ্ছে তার। তবু নিজের অন্ধত্ব আর দুর্দশার কথা না ভেবে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন এই গৃহবধূ।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন পারভীন। তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সোমবার (৪ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ জবানবন্দি দেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

বিজ্ঞাপন

চোখ হারানোয় এদিন অন্যের সহায়তায় সাক্ষ্য কাঠগড়ায় আসেন পারভীন। শুরুতেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেন। জবানবন্দিতে জানান, তার নাম পারভীন। বয়স ২৭ বছর। স্বামীর সঙ্গে আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে থাকতেন। দিনমজুরের কাজ করে সংসারে সহায়তা করতেন। চব্বিশের ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো সকালে বাসায় নিজেদের রান্নাবান্না শেষে জুরাইনে লেগুনায় চড়ে কাজে যান। বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ শেষে ফের লেগুনা স্ট্যান্ডে আসেন। তবে কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই রওনা হন।

পারভীন বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী এসে দেখি অনেক মানুষ আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। কারও হাত নেই, আবার কারও পা নেই। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে ১৮-১৯ বছরের একটা ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখি। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল সে। আমার মায়া হলে তার কাছে দৌড়ে যাই। দেখি তার সারা শরীর রক্তাক্ত। দুই চোখ দিয়েও রক্ত ঝরছিল।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেটির গলায় একটি আইডি কার্ড ছিল। পরনে সাদা প্যান্ট-গেঞ্জি। ছেলেটি শুধু বলে আমাকে বাঁচান। পরে টেনে তুললে আমার ঘাড়ে তার মাথা ফেলে দেয়। তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। এমন সময় ১৪-১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ মারমুখী হয়ে ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এমনভাবে গুলি করছিল যেন খই ফুটছিল। অনেক গুলি ছেলেটার পিঠে লাগে। আমি বাঁ হাত তুলে গুলি না করার জন্য অনুরোধ করি। এর পর একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে।’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এই সাক্ষী।

দিনমজুর পারভীন বলেন, ‘ওই সময় দু-তিনজন পুলিশ আরও গুলি চালাতে থাকে। এতে আমার হাত-তলপেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগে। ওই সময় আহত ছেলেটি আমার কাঁধে। গুলি লাগায় আমার চোখের ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্তে যেন পুরো রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। আমি প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁতরাচ্ছিলাম। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়লে ছেলেটাকে নিয়ে আমি পড়ে যাই।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘ঠিক ওই মুহূর্তে আমাকে চেপে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় ছেলেটি। আমার মনে হয়েছিল ছেলেটি মারা যায়। আর ব্যথার যন্ত্রণায় আমি ছটফট আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলাম। পরে লোকজন এসে ছেলেটিকে মৃত ও আমাকে জীবিত দেখে সিএনজিতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা পুলিশ কেস বলে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের চাপাচাপিতে সেবা দিতে বাধ্য হন।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় একজন নার্স এসে আমার কাছে ২৫০ টাকা চান একটা ড্রপ কেনার জন্য। আমি টাকা নেই বলে জানাই। তখন অন্য একজন নারী টাকা দিলে ড্রপ কিনে আনা হয়। ড্রপটি আমার চোখে দিতেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁতরাতে থাকি। এরপর আমার আর কোনো চিকিৎসা না দিয়ে চিকিৎসকরা চলে যান। আমি বারান্দায় পড়ে থাকি।’

দিনমজুর এই নারী বলতে থাকেন, ‘এক পর্যায়ে বমি করে দিই। তখন একজন মহিলার মাধ্যমে আমার স্বামীকে কল করলে পরদিন সকাল ১০টায় বরিশাল থেকে হাসপাতালে আসেন। তখন ডাক্তারের রুমে ঢুকে চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করেন আমার স্বামী। পরে চিকিৎসা সংক্রান্ত (অপারেশনের জন্য) কিছু কেনার জন্য একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন তারা। তখন বাসায় গিয়ে আমার স্বামী কিছু আসবাবপত্র ও আমার কানের দুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। এর পর আমার অপারেশন হয়। আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়।’

‍ভুক্তভোগী বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে তিন-চারদিন চিকিৎসা দিয়ে আমাকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। আমার স্বামী নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শরীরে ও চোখে আরও গুলি রয়েছে বলে জানানো হয়। একইসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলা হয়। কিন্তু ভর্তি করলেও অপারেশন করা হয়নি। অপারেশন হয়েছে ৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ওই সময় চোখ থেকে বড় গুলি বের করা হয়। তলপেটের গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। আমি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এর পরও ন্যায়বিচার পেতে আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা অবহেলার কারণে আমার বাঁ চোখ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখে ঝাপসা দেখি। আমার এই অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের জন্য একমাত্র দায়ী শেখ হাসিনা। কেননা তিনি ছিলেন পুলিশের বাপ-মা। তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছিল। তার নির্দেশ ব্যতীত পুলিশ করতে পারে না। আমার মতো হাজার হাজার মানুষকে আহত-নিহত করা হয়েছে। তাই তাদেরসহ আমার অন্ধত্বের বিচার চাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই সাক্ষী আরও বলেন, ‘আমার নয় বছর ও চার বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। আমার সন্তানদের কে দেখবে। তাদের কাছে আমি এখন অন্ধ মা। আমার দুই সন্তানও চায় তার মায়ের অন্ধত্বের বিচার হোক। সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে যেসব সরকার আসবে, তারাও একইভাবে মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। ভাববে হত্যার বিচার হয় না।’

বিকেল প্রায় ৩টা পর্যন্ত তার জবানবন্দি শোনেন ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। ট্রাইব্যুনালে এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউপর গাজী এমএইচ তামিম, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

এ মামলায় শেখ হাসিনা ও কামাল পলাতক থাকলেও গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। রাজসাক্ষী হিসেবে তাকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পারভীন ছাড়াও আরেকজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলন ঘিরে নিজের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তার নাম আবদুল্লাহ আল ইমরান। এছাড়া শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে ৩ আগস্ট জবানবন্দি দেন এ মামলার প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ।

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম