ঢাকা: ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের গণজমায়েতে তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আগামী ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালন করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন মাঝখানে দুইদিনের (৪ ও ৫ আগস্ট) আল্টিমেটাম দেয় সরকারকে। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালন করা হবে।
কিন্তু ৪ আগস্ট ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং অনেক প্রাণহানি ঘটে। এতে সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে এবং প্রতিবাদ জানায়। কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ায়। ফলে পরিস্থিতি পালটে যায়। তবে রাত ৮টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ঘোষণা করেন— পরশু নয়, আগামীকালই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি।
তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “জরুরি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। সারা দেশ থেকে মুক্তিকামী জনগণকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়ে যান। চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আপনারা সবাই চলে আসুন। কৃষক, শ্রমিক, দিন মজুর, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী সবাই চলে আসুন। আমরা শাহবাগে জড়ো হওয়ার পর গণভবনের দিকে যাত্রা করব। চূড়ান্ত বিজয় খুবই কাছে চলে আসছে। জানি না, আজকের পর আমাদের অবস্থা কী হবে। জানি না আমরা বেঁচে থাকতে পারব কিনা? আমরা না থাকলেও আপনারা রাজপথে থেকে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বিদায় করেই ঘরে ফিরবেন।’
আসিফ মাহমুদের এই ঘোষণার পর আলোচনা শুরু হয় যে, সমন্বয়কদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আসিফ মাহমুদের এই ভিডিও সঠিক নয়। বলা হয়, এক গ্রুপ সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, আরেক গ্রুপ আন্দোলন চালিয়ে নিতে চাচ্ছে। এর পর আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও ফেসবুক পোস্টে ঘোষণা দেন— পরশু নয়, কালকেই ‘লং মার্চ টু ঢাকা!’ এর কিছুক্ষণ পর রাত ১০টার দিকে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ লিখেন, আগামীকালই ‘মার্চ টু ঢাকা’। ইতিহাসের সাক্ষী ও চূড়ান্ত লড়াইয়ে শামিল হতে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করুন এখনই।’
এদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি না দাঁড়ানোর আহ্বান জানায় সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশে চলমান ‘বেদনাদায়ক’ সহিংসতা দ্রুত বন্ধ করতে বিবৃতি দেয় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের প্রধান ফলকার তুর্ক। তিনি সেনাপ্রধানের উদ্দেশে একটি চিঠিও লেখেন।
যে যাই বলুক না কেন- চূড়ান্ত বিজয়ের টার্নিং পয়েন্ট ছিল এই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত। কিন্তু কেন একদিন এগিয়ে আনা হয়েছিল?— এখন পর্যন্ত তা কেউ জানতে পারেনি। সারাবাংলার পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ একাধিক সমন্বয়ক, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা পরামর্শকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- আসলে সেই রহস্যটা কী ছিল।
৩ আগস্ট যখন ঘোষণা করা হয়, ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। ঠিক তখন থেকেই সরকার চাপে পড়ে যায়। কর্মসূচি নস্যাৎ করতে সবধরণের পরিকল্পনা শুরু করে। সব জেলা থেকে পুলিশ ফোর্স ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া র্যাব, পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও সেনাবাহিনী কীভাবে কাজ করবে তার একটি নকশা তৈরি করা হয়। আকাশে বিমান কীভাবে কাজ করবে তাও পরিকল্পনায় আনা হয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ঢাকা মহানগরীর পাশাপাশি বাইরের নেতারা এসে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে তার চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিশেষ করে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এসে যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে থেকে ছাত্র-জনতাকে মোকাবিলা করতে পারে তাও চূড়ান্ত করা হয়।
সরকারের মূল পরিকল্পনা ছিল, যেকোনো মূল্যে ঢাকা সামাল দিতে হবে। কিন্তু বিষয়টি টের পেয়ে যায় প্রশাসনে থাকা সরকারবিরোধী কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টি আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের জানিয়ে দেয়। তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনতে হবে। এতে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা নস্যাৎ হবে। কথা অনুযায়ী কাজ। এর পর ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট ঘোষণা করা হয়।
এদিকে, মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্ট হওয়ার কথা থাকলেও আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নেপথ্যে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা বুঝতে পারেন যে, সরকার ৫ আগস্ট কাউকে ঢাকায় ঢুকতে দেবে না। এমনকি সবধরণের যানবাহনও বন্ধ করতে পারে সরকার। এ জন্য ‘মার্চ টু ঢাকা’ ৬ আগস্ট ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ৩ আগস্ট রাতে এবং ৪ আগস্ট সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ঢাকায় প্রবেশ করে। আর যারা ৪ আগস্ট রাতে রওনা হয়েছিল তারা ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান নেয়। সমন্বয়করা যখন বুঝতে পারেন, আন্দোলন চূড়ান্তভাবে এগিয়ে নেওয়ার মতো ছাত্র-জনতা এখন প্রস্তুত, ঠিক তখনই চূড়ান্ত ঘোষণা আসে- ‘মার্চ টু ঢাকা’ ৬ আগস্ট নয়, ৫ আগস্ট।
৪ আগস্ট রাতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে কেউ কেউ দ্বিধাবিভক্তির খবর ছড়ায়। তাদের উদ্দেশ্যইবা কী ছিল। এ বিষয়ে তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এটা ছড়িয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমন্বয়কদের নামে এসব ছড়ালে সাংবাদিক ও পাবলিক বিশ্বাস করবে না। জনগণও বিভক্ত হয়ে যাবে। তখন আন্দোলন সফল হবে না। তাছাড়া কিছু সাংবাদিকও (যারা সরকারকে খুবই পছন্দ করতেন) রয়েছেন যারা এই দ্বিধাবিভক্তিতে জড়িত ছিলেন।’
৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ওইদিন দুপুর ১টার দিকে ঘোষণা আসে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সবার ধারণা ছিল ২০০৭ সালের মতো এবারও সেনাশাসন আসছে। তবে পরবর্তী সময়ে সেনাকুঞ্জে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সব রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়। যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট।
এর আগে, ৫ আগস্ট সকালের দিকে সেনাপ্রধানের ভাষণের কথা শুনে উত্তরা দিয়ে জনস্রোত প্রবেশ করতে থাকে ঢাকায়। যাত্রাবাড়ী দিয়েও লাখো জনতা স্রোতের মতো প্রবেশ করে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকাবাসী সড়কে নেমে আসে। আবালবৃদ্ধবণিতা অলিগলি আর সড়কে উল্লাসে মাতে। খুশিতে উদযাপন করে ১৫ বছরের অপশাসনের গ্লানি। সবাই মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকে। কেউ গণভবনে গিয়ে সিজদায় নত হয়। স্বৈরাচার পালানোর খুশিতে গণভবনের সম্পদ যেন অনেকে নিজের করে নেয়। যে যা পারে তাই স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য অনেকেই গণভবনের অনেককিছু ফেরত দিয়ে গেছে।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে দেশ ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়। তবে ঝড়ে যায় সহস্রাধিক প্রাণ। আহত হন অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১ জুন। আর শেষ হয় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। যা ছিল দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল।